<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ |
|| ওম নমঃ ভগবতে বাসুদেবায় ||
শ্রীমদ্ভাগবতম - প্রথম স্কন্ধ - চতুর্থ অধ্যায়
মহর্ষি ব্যাসের অপ্রসন্নতা এবং দেবর্ষি নারদের আবির্ভাব
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমের প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায় , ভগবানের অবতারগণের বর্ণনা সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমের প্রথম স্কন্ধের চতুর্থ অধ্যায় , মহর্ষি ব্যাসের অপ্রসন্নতা এবং দেবর্ষি নারদের আবির্ভাব সম্পর্কে জানব । এটি শুরু হয় সূত গোস্বামী দ্বারা শৌনকাদি মুনিদের প্রশ্নের উত্তর প্রদানের মাধ্যমে ।
শ্রীমদ্ভাগবতম - প্রথম স্কন্ধ - চতুর্থ অধ্যায় |
২) শৌনক মুনি বললেন - হে সূত গোস্বামী ! আপনি এই অপরুপ ভাগবতকথা বর্ণনাকারীদের মধ্যে যোগ্যতম । মহর্ষি শুকদেবের সেই পবিত্র বাণী আপনি কৃপা করে আমাদের শ্রবণ করান যা তিনি পূর্বে পরীক্ষিত মহারাজকে শ্রবণ করিয়েছিলেন ।
৩) এই শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র কোন যুগে , কোন স্থানে এবং কোন কারণের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল ? মহামুনি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব কি প্রকারেই বা অনুপ্রাণিত হয়ে এই বৈদিক শাস্ত্রের সংকলন করেছিলেন ?
৪) মহামুনি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের পুত্র শ্রীশুকদেব গোস্বামী ছিলেন মহাযোগী , অদ্বিতীয় তত্বজ্ঞানী , সর্বদাই পারমার্থিক সাধনে একাগ্র এবং তাঁর মতো সমদ্রষ্টা কেউই ছিলেন না । তিঁনি সংসারবিচ্ছিন্ন , ভেদজ্ঞানশূন্য এবং সমস্ত প্রকার জড়-জাগতিক কার্যকলাপের উর্ধে ছিলেন কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তিনি একজন মুঢ় ব্যক্তির ন্যায় প্রতিভাত হতেন ।
৫) মহামুনি ব্যাসদেবের পুত্র শ্রীশুকদেব যখন সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য অরণ্য মধ্যে গমন করছিলেন এবং মহর্ষি ব্যাসদেব পুত্রকে অনুসরণ করছিলেন , তখন নগ্ন অবস্থায় স্নানরতা সুন্দরী রমণীগণ জলকেলি করার সময় পথে শ্রীশুকদেবকে দেখে বস্ত্র পরিধান করেননি , কিন্তু ব্যাসদেবকে আসতে দেখে রমণীগণ বস্ত্র পরিধান করেছিলেন । ব্যাসদেব এই দেখে আশ্চর্যবৎ ও বিস্মিত হয়ে যখন তাদের প্রশ্ন করেছিলেন ,তখন সুন্দরী রমণীগণ তাঁর উত্তরে বলেছিলেন , আপনার পুত্রের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই , কিন্তু মহামুনি ব্যাসদেব আপনার দৃষ্টিতে সেই ভেদাভেদ রয়েছে ।
৬) কুরু-জাঙ্গল দেশে শ্রীশুকদেব উন্মাদ , মূক ও জড়ের মতো বিচরণ করে যখন হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হন তখন তাঁকে দেখে পুরবাসীগণ কিভাবে চিনতে পেরেছিলেন ?
৭) কিভাবেই বা মহারাজ পরীক্ষিতের সাথে শ্রীল শুকদেবের সাক্ষাৎ হয়েছিল যার ফলস্বরূপ সমগ্র বেদের এই অপ্রাকৃত নির্যাস শ্রীমদ্ভাগবত সংহিতার প্রচলন হয়েছিল ?
৮) মহর্ষি শুকদেব তো কেবলমাত্র গোদোহনকাল পর্যন্ত গৃহকর্তার দ্বারে অবস্থান করতেন এবং তা কেবলমাত্র তাদের গৃহ পবিত্র করবার জন্য করতেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতম - প্রথম স্কন্ধ - চতুর্থ অধ্যায় |
৯) হে সূত গোস্বামী ! আমরা জানি পান্ডব বংশজাত অভিমন্যুর পুত্র রাজা পরীক্ষিৎ পরমেশ্বর ভগবানের উত্তম ভক্ত ছিলেন । তাঁর অত্যন্ত আশ্চর্য কার্যকলাপ এবং জন্মবৃত্তান্ত কৃপা করে আমাদের বর্ণনা করুন ।
১০) তিনি তো পান্ডববংশের শোভা বর্ধনকারী সম্রাট ছিলেন । এই সুবিশাল ঐশর্য হেলায় ফেলে রেখে রাজা পরীক্ষিৎ গঙ্গার তটে গিয়ে আমৃত্যু অনশন করেছিলেন কেন ?
১১) তিনি এমনই এক মহান বীর যোদ্ধা ছিলেন , যে শত্রুরা তার পায়ে নতজানু হয়ে হার স্বীকার করে তাদের ধনসম্পদ রাজাকে উপহার হিসেবে সমর্পণ করতেন । তিনি ওই সুবিশাল বৈভব এমনকি নিজপ্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করার সংকল্প কেন নিয়েছিলেন ?
১২) যিনি পরমেশ্বর ভগবানের পরম ভক্ত, তিনি কেবল জগৎ সংসারের মঙ্গল ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য জীবন ধারণ করেন । তিনি নিজের ব্যাক্তিসাধনের জন্য কোনো কিছু করেন না । কিন্তু কি কারণে তিনি নশ্বর দেহ ছেড়ে, জড় জগৎ থেকে যেতে চাইছেন ?
১৩) আপনি বেদের কিয়ৎ অংশ ব্যতীত সমস্ত শাস্ত্রের জ্ঞাতা ও জ্ঞানের ভান্ডার । তাই আমরা মনে করি আপনি আমাদের এই মনের জিজ্ঞাসাগুলির উত্তরপ্রদানে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম । তাই হে মহামতি সূত ! আপনি আমাদের উপর কৃপা করে এইসকল প্রশ্নগুলির সমাধান করুন ।
১৪) সূত গোস্বামী বললেন - এই চতুর্যুগের তৃতীয় অর্থাৎ দ্বাপর যুগে মহর্ষি পরাশরের ঔরসে মাতা সত্যবতীর ( মৎস্যগন্ধা ) গর্ভে পরমেশ্বর ভগবানের কলাবতার রূপে মহর্ষি ব্যাসদেব আবির্ভূত হন ।
১৫) একদিন মহর্ষি ব্যাসদেব সূর্যোদয় কালে পবিত্র সরস্বতী নদীর জলে স্নানাদি সমাপন করে নদীর তটে একাগ্র চিত্তে বসেছিলেন ।
১৬) অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মহর্ষি ব্যাসদেব অবগত ছিলেন । তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন যে অপ্রকাশিত মহাশক্তির প্রভাবে যুগোচিত ধর্ম কালের করাল গ্রাসে পৃথিবী থেকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকছে ।
শ্রীমদ্ভাগবতম - প্রথম স্কন্ধ - চতুর্থ অধ্যায় |
১৭) মহর্ষি ব্যাসদেব দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে সত্ত্বগুণের অভাবে মানুষের স্বাভাবিক শক্তি ও আয়ু হ্রাস পাচ্ছে । দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ায় তারা তাদের কর্তব্য কর্ম সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে পারছেনা ।
১৮) মহর্ষি ব্যাসদেব কলির সমস্ত বর্ণের জীবসকল ও আশ্রমের এই দুর্দশা দেখে চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছিলেন এবং সমস্ত বর্ণ ও আশ্রমের পক্ষে যা মঙ্গলজনক তার উপায় নিরুপনের প্রচেষ্টা করছিলেন ।
১৯) তিনি অনেক চিন্তা করে , বৈদিক নির্দেশ অনুসারে , প্রজাগণের পবিত্র কর্মানুষ্ঠান যজ্ঞকে বিস্তার করার জন্য বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন ।
২০) মহর্ষি ব্যাস বেদকে ঋক ,যজু ,সাম এবং অথর্ব এই চারটি ভাগে বিভক্ত করেন । ইতিহাস এবং পুরাণকেও পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে ।
২১) তার শিষ্যগণের মধ্যে ঋষি পৈল ঋকবেদ , ঋষি জৈমিনি সামবেদ , ঋষি বৈশম্পায়ন যজুর্বেদের উপর বিশেষ ভাবে পারদর্শী ছিলেন ।
২২) দারূননন্দন সুমন্ত মুনি ছিলেন অথর্ববেদ শাস্ত্রী এবং আমার পিতা ঋষি রোমহর্ষণ ইতিহাস ও পুরাণ বিষয়ের উপর বিশেষ ভাবে পারদর্শী ছিলেন ।
২৩) তত্ত্বজ্ঞানী ঋষিগণ নিজ নিজ বিষয়ের এই সকল বেদকে শিষ্য , প্রশিষ্য এবং প্রশিষ্যর শিষ্যদের মধ্যে দান করেন । আর এই ভাবেই সেই সমস্ত বেদের অনুগামীদের থেকে বেদের বিভিন্ন শাখা হয়ে যায় ।
২৪) কলিযুগে অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা যাতে সহজেই বেদকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে , সেই জন্য মহর্ষি ব্যাসদেব তাদের উপর কৃপা করে বেদকে চারটি খন্ডে বিভক্ত করেছেন ।
২৫) স্ত্রী , শুদ্র এবং দ্বিজবন্ধু ( দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন দ্বিজকুলোদ্ভূত মনুষ্যরা ) অজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকার কারণবশত বেদের তাৎপর্য সঠিক ভাবে বোধগম্য করতে সক্ষম হন না । এমতাবস্থায় তাদের উপর কৃপা করে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক পবিত্র ইতিহাস রচনা করেছিলেন , যাতে তাদের জীবনের কল্যাণসাধন হয় ।
শ্রীমদ্ভাগবতম - প্রথম স্কন্ধ - চতুর্থ অধ্যায় |
২৬) হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ শৌনকাদি মুনিগন ! এইভাবে যদিও মহর্ষি ব্যাসদেব সর্বদা জীবের সর্বাঙ্গীন কল্যাণসাধনে তৎপর ছিলেন কিন্তু তবুও তার চিত্ত শান্ত ছিল না ।
২৭) অপ্রসন্ন হৃদয়ে সরস্বতী নদীর তটে উপবিষ্ট ধর্মতত্ত্ববেত্তা মহর্ষি ব্যাসদেব তৎক্ষণাৎ গভীর বিচারে মগ্ন হলেন এবং ওই নির্জন স্থানে তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন -।
২৮) কঠোর ব্রতপালন ও নিষ্কপটভাবে ব্রহ্মচর্যাদি আচরণের মাধ্যমে আমি বেদ, গুরুবর্গ এবং অগ্নির পূজা করেছি ও তাদের নির্দেশ আমি যথাযত ভাবে পালন করেছি ।
২৯) গুরুপরম্পরায় লব্ধ জ্ঞান ও বেদের মর্মার্থ আমি অতি সরল ভাবে মহাভারতের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছি যাতে স্ত্রী , শুদ্র , ব্রহ্মবন্ধু ইত্যাদি সবাই নিজ ধর্ম কর্ম পালনের মাধ্যমে ধর্মপথাবলম্বী হন ।
৩০) যদিও আমি ব্রহ্মতেজসম্পন্ন , বৈদিক দর্শনে জ্ঞাত ও সমর্থ তবুও আমি হৃদয়ে কেমন যেন অপূর্ণতা অনুভব করছি ।
৩১) আমার এই অসন্তোষের কারণ হয়তো এই যে আমি আজ পর্যন্ত ভাগবতপ্রাপ্তির কান্ডারী ভগবদ্ভক্তির বিশেষভাবে বর্ণনা করিনি যা পরমহংসদের এবং পরমেশ্বর ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় ।
৩২) মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস যখন নিজের অপূর্ণতা বিবেচনা করে দুঃখিত হৃদয়ে সরস্বতী নদীর তীরে অনুশোচনা করছিলেন তখন দেবর্ষি নারদ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন ।
৩৩) সমগ্র দেবতাদের দ্বারা পূজিত দেবর্ষি নারদকে দেখে মহর্ষি ব্যাস তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন এবং শ্রদ্ধা সহকারে তার পূজা , অভ্যর্থনা করলেন ।
। ইতি শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীমহাপুরাণে পারমহংস্যাং সংহিতায়াং প্রথমস্কন্ধে নৈমিষীয়োপাখ্যানে চতুর্থোহধ্যায়ঃ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই,আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ||
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগলো তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
No comments:
Post a Comment