Bhagavatam, Srimad Bhagavatam, Bhagavata Purana, Srimad Bhagavatam in Bengali, Bhagavata Purana in Bengali, Bhagavata Mahapurana, Sanatana Dharma, Bhagavata Mahapurana, Srimad Bhagavatam Bangla, Gita, শ্রীমদ্ ভাগবতম, শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরান, শ্রীমদ্ ভাগবত পুরান, Srimad Bhagavatam online , শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ -প্রথম অধ্যায় , দেবর্ষি নারদের ভক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকার, Srimad Bhagavatam Mahatmyam Chapter 1
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা স্বয়ং শ্রীভগবান কর্তৃক ব্রহ্মাকে বর্ণিত শ্রীমদ্ভাগবত মাহাত্ম্য সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা মূল শ্রীমদ্ভাগবত শুরু করব । এটি শুরু হয় শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের প্রথম অধ্যায় , দেবর্ষি নারদের ভক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গের সাথে ।
১) যিনি এই সমগ্র জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের হেতু তথা আধ্যাত্মিক , আধিভৌতিক , আধিদৈবিক - এই ত্রিতাপের বিনাশকারী , সেই সচ্চিদানন্দস্বরূপ , পরম ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রকে আমরা অনন্তকোটিবার প্রণাম করি ।
২) মহর্ষি ব্যাসদেব এর সুপুত্র, মহাজন শুকদেবের তখনও উপনয়ন সংস্কার হয়নি, অর্থাৎ তার লৌকিক বৈদিক সমস্ত কর্মানুষ্ঠান তখনও বাকি, এমতাবস্থায় তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প নিয়ে একাকী গৃহত্যাগে উদ্যোগী হয়েছেন । তাই দেখে তাঁর পিতা মহর্ষি ব্যাসদেব পুত্রবিরহে, কাতরস্বরে বলে উঠলেন - হে পুত্র ! তুমি কোথায় চলেছ ? সেই সময় তন্ময় হওয়ার ফলে বৃক্ষরাজি শুকদেবের হয়ে উত্তর দিয়েছিল । এইরূপ সর্বভূত-হৃদয়স্বরূপ শুকদেবমুনিকে আমি প্রণাম করি ।
৩) একদা ভাগবতকথামৃত রসাস্বাদনকুশল মুনিবর শৌনক নৈমিষারণ্যক্ষেত্রে বিরাজমান মহামতি সুতকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলেন ।
৪) শৌনক বললেন - হে সুত ! অজ্ঞান অন্ধকার দূরীকরণে আপনার জ্ঞান কোটি সূর্যদেবের ন্যায় প্রভাময় । আপনি আমাদের কর্ণের তৃপ্তিবিধানকারী এবং অমৃতস্বরূপ সারগর্ভ কথা বলুন ।
৫) ভক্তি, জ্ঞান, ও বৈরাগ্য দ্বারা লভ্য মহান বিবেকের বিকাশ কি রূপে হয় এবং বৈষ্ণবগণ কি প্রকারে জগতের এই সর্বপ্রকার মায়া-মোহ থেকে নিজেদের মুক্ত করেন ?
৬) এই ঘোর কলিকালে জীব প্রায়শই আসুরিক স্বভাবসম্পন্ন হয়েছে, নানাবিধ ক্লেশে ক্লিষ্ট এই জীবসমূহকে পরিশুদ্ধ করার সর্বশ্রেষ্ট উপায় কি ?
৭) হে সুত ! আপনি এমন কোনো শাশ্বত সাধন-পথের সন্ধান দিন, যা সর্বাপেক্ষা কল্যাণকারী এবং পবিত্রকর, আর যার দ্বারা পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায় ।
৮) চিন্তামণি কেবলমাত্র লৌকিক সুখই দিতে পারে আর কল্পবৃক্ষ বড়োজোর স্বর্গীয় সম্পদাদি দিতে পারে, কিন্তু গুরুদেব প্রসন্ন হলে শ্রীভগবানের যোগীদুর্লভ নিত্য শ্রী বৈকুণ্ঠধাম দিতে পারেন ।
৯) সুত বললেন - হে শৌনক ! তোমার হৃদয়ে স্বাত্তিক ভগবৎপ্রেম রয়েছে ; তাই আমি বিচার করে তোমাকে সমস্ত সিদ্ধান্তের গভীর ও গুঢ় সারকথা শোনাচ্ছি, যা জন্মমৃত্যুর ভয় দূরীভূত করে ।
১০) আমি তোমাকে ভক্তিপ্রবাহ বৃদ্ধিকারী এবং সচ্চিদানন্দস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতা অর্জনকারী সাধনের কথা বলবো ; মন দিয়ে শোনো ।
১১) মহর্ষি শুকদেব এই ঘোর কলিযুগে জীবকে কালরুপী সর্পের গ্রাসে পতিত হওয়ার মহাভয় থেকে রক্ষা করার জন্য শ্রীমদ্ভাগবত-শাস্ত্রের প্রবচন করেছেন।
১২) মানবের চিত্তশুদ্ধির জন্য এর থেকে মঙ্গলকারী আর কোনো সাধন নেই । কোটি কোটি জন্মজন্মান্তরের পুণ্যের উদয় হলে তবেই মানুষের এই ভাগবত শাস্ত্রের প্রাপ্তি হয় ।
১৩) রাজা পরীক্ষিৎকে এই ভাগবতকথা শোনাবার জন্য মহর্ষি শুকদেব যখন সভায় সমাসীন ছিলেন, তখন অমৃতকুম্ভ হাতে নিয়ে দেবতারা তাঁর কাছে আসেন ।
১৪) নিজেদের কার্যসিদ্ধিতে অতীব কুশল দেবতারা মহর্ষি শুকদেবকে প্রণাম করে বললেন - আপনি এই অমৃতকুম্ভ গ্রহণ করে তার পরিবর্তে আপনার কথামৃত আমাদের প্রদান করুন ।
১৫) এই প্রকারে আমরা পরস্পরের মধ্যে কথামৃত এবং অমৃত বিনিময় করার মাধ্যমে , মহারাজ পরীক্ষিৎ অমৃত পান করতে থাকুন আর আমরা দেবতারা সকলে শ্রীমদ্ভাগবতরূপ অমৃত পান করি ।
১৬) এই সংসারে কাঁচ আর মহামূল্য মনি যেমন, ঠিক তেমনি কোথায় অমৃত আর কোথায় ভাগবতকথা ! এই চিন্তা করে মহর্ষি শুকদেব দেবতাদের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন ।
১৭) দেবতাদের কথা শ্রবনে অনধিকারী, ভক্তিহীন বুঝতে পেরে মহর্ষি শুকদেব তাদের এই ভাগবতকথামৃত দেননি, এই কারণে শ্রীমদ্ভাগবতকথা দেবতাদেরও দুর্লভ বলা হয় ।
১৮) পুরাকালে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবনের ফলে মহারাজ পরীক্ষিৎকে মোক্ষলাভ করতে দেখে স্বয়ং ব্রহ্মাও বিস্মিত হয়েছিলেন । তিনি সত্যলোকে সকল প্রকার সাধনকে ওজনে বিচার করেছিলেন ।
১৯) ওজনে ভাগবতই নিজ মাহাত্ম্যে অপর সব সাধন অপেক্ষা ভারী হয় । তা দেখে মুনি-ঋষিরা সকলেই চমৎকৃত হন ।
২০) তারা এই সিদ্ধান্ত করলেন যে কলিযুগে ভগবতস্বরূপ এই ভাগবতশাস্ত্রেরই পাঠ এবং শ্রবণে তাৎক্ষণিক মোক্ষপ্রাপ্তি সম্ভব ।
২১) সপ্তাহ-বিধি অনুসারে শ্রবণে শ্রীমদ্ভাগবতশাস্ত্র নিশ্চিত ভক্তি প্রদান করে । পুরাকালে দয়ালু সনকাদি মুনিগণ দেবর্ষি নারদকে এই পুন্যশাস্ত্র শ্রবণ করিয়েছিলেন ।
২২) যদিও দেবর্ষি নারদ পূর্বেই ব্রহ্মার নিকট এই শাস্ত্র শ্রবণ করেন তবুও সপ্তাহ-শ্রবণের বিধি সনকাদি ঋষিগণই তাঁকে বলেছিলেন ।
২৩) শৌনক প্রশ্ন করলেন - বিষময় এই সাংসারিক প্রপঞ্চ থেকে মুক্ত পরিব্রাজক দেবর্ষি নারদের সাথে সনকাদি মুনিগণের কোথায় সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং বিধিসম্মত সপ্তাহব্যাপী ভাগবত শ্রবণান্তে তিনি কি প্রকারে প্রীত হয়েছিলেন ?
২৪) সুত বললেন - আমি এখন তোমাকে সেই ভক্তিমূলক কথা শোনাচ্ছি , যে কথা মহর্ষি শুকদেব তার শিষ্যগণের মধ্যে, আমাকে যোগ্য বিবেচনা করে একান্তে শ্রবণ করিয়েছিলেন ।
২৫) একদা এই চারজন পবিত্র বাল-ঋষিগণ বিশাল নগরী তে এসেছিলেন সৎসঙ্গ করার উদ্দেশ্যে । সেখানে তারা দেবর্ষি নারদকে দেখতে পান ।
২৬) সনকাদি মুনিগন দেবর্ষি নারদকে প্রশ্ন করলেন - হে ব্রহ্মন্ ! আপনাকে এত ব্যাকুল দেখাচ্ছে কেন ? এত কি চিন্তা করছেন ? এত দ্রুত চলেছেনই বা কোথায় ? এবং আপনি এলেনই বা কোথা থেকে ?
২৭) আপনাকে হৃতসর্বস্ব ব্যক্তির মতন ব্যকুল দেখাচ্ছে । আপনার মতন নিরাসক্ত পুরুষের পক্ষে এইরকম ব্যাকুলতা শোভা পায় না । এর কারণ কি বলুন ?
২৮-৩০) নারদ বললেন - এই ভুলোককে সর্বশ্রেষ্ঠ লোক মনে করে আমি এখানে এসেছি । এখানে আমি পুষ্কর, প্রয়াগ, কাশী, গোদাবরী, হরিদ্বার, কুরুক্ষেত্র, শ্রীরঙ্গ, সেতুবন্ধ রামেশ্বরাদি, প্রভৃতি তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করেছি; কিন্তু কোথাও মনের শান্তি পেলাম না । অধর্মের পরম সহায়ক কলিযুগ বর্তমানে এই পৃথিবীকে আষ্টেপিষ্টে ক্লিষ্ট করে রেখেছে ।
৩১-৩৩) এখন এখানে সত্য, তপস্যা, শৌচ ( পবিত্রতা ), দয়া, দান কিছুরই অবশিষ্ট নেই । হতভাগ্য জীবগণ কেবলমাত্র নিজ নিজ উদরপূর্তির চিন্তাতেই মগ্ন । তারা অসত্যভাষী, অলস, মন্দবুদ্ধি, ভাগ্যহীন ও উপদ্রবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । যাদের সাধু-সন্ত বলা হয় তারা সকলেই পাষন্ড আচারনিরত হয়ে গিয়েছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের বৈরাগী মনে হলেও স্ত্রীধনাদী তারা নির্বিকারেই গ্রহণ করে । বাড়িতে কেবলই স্ত্রীরাজত্ব, শ্যালকগণই প্রধান পরামর্শদাতা, লোকেরা লোভে বশীভূত হয়ে কন্যাবিক্রয় করে এবং স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে নিত্য কলহ লেগেই আছে ।
৩৪) মহাত্মাদের আশ্রম, তীর্থ ও পবিত্র নদীগুলি বিধর্মী ম্লেচ্ছ যবনরা ( মুসলিমরা ) দখল করে রেখেছে এবং ওই সব নরাধম দুর্বৃত্ত নীচ বিধর্মী ম্লেচ্ছ যবনরা ( মুসলিমরা ) বহু দেবালয় ধ্বংস করেছে ।
৩৫) বর্তমানে ভূতলে না আছে কোনো যোগী না কোনো সিদ্ধপুরুষ, না আছে কোনো জ্ঞানী পুরুষ, না আছে কোনো সৎকর্মপরায়ণ মানুষ । যা কিছু সাধন ছিল তা এই কলিরূপ দাবানলে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে ।
৩৬) এই কলিযুগে প্রায় সকলেই অন্ন বিক্রয় করছে, ব্রাম্ভনেরা অর্থের বিনিময়ে বেদশিক্ষা দিচ্ছে আর স্ত্রীলোকেরা বেশ্যাবৃত্তির দ্বারা জীবীকা নির্বাহ করছে ।
৩৭) এইরূপ কলির দোষসকল দেখতে দেখতে পৃথিবী পরিভ্রমণকালে আমি যমুনা তীরে সচ্চিদানন্দস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমিতে উপস্থিত হই ।
৩৮) হে মুনিগন ! শুনুন, আমি সেখানে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম । একজন যুবতী স্ত্রী বিষন্ন মনে বসেছিল ।
৩৯) তার পাশে দুইজন অচেতন বৃদ্ধ পুরুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল । সেই স্ত্রীলোকটি কখনও তাদের শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছিল আবার কখনও তাদের সামনে ক্রন্দন করছিল ।
৪০) ওই অবস্থায় সে তার শরীরের রক্ষক পরমাত্মাকে দশদিকে দর্শন করছিল, শত শত নারী তাকে ঘিরে হাওয়া করছিল আর প্রবোধ দিচ্ছিল ।
৪১) দূর থেকে এই ঘটনা লক্ষ্য করে আমি কৌতূহলের বশে ওই যুবতীর কাছে গেলাম, আমাকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল আর অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগল।
৪২) যুবতীটি বলল - হে মহাত্মন ! কৃপাকরে এই স্থলে ক্ষণমাত্র অবস্থান করুন এবং আমাকে দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত করুন । আপনার দর্শনে মানুষের সকল পাপের নিবৃত্তি হয় ।
৪৩) আপনার উপদেশবাক্যে আমার দুঃখেরও শান্তি হবে, বহু ভাগ্যে আপনার দর্শন প্রাপ্তি হয় ।
৪৪) নারদ বললেন - আমি তখন সেই নারী কে জিজ্ঞেস করলাম দেবী ! তুমি কে ! এই পুরুষ দুজন তোমার কে হয় ? আর তোমার চারপাশে এই যেসব কমললোচনা নারীরা রয়েছে, এরা করা ? তোমার দুঃখের কথা তুমি আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা কর ।
৪৫) যুবতীটি বলল - আমার নাম ভক্তি, এই দুইজন পুরুষ আমার দুই ছেলে জ্ঞান ও বৈরাগ্য । কালের প্রকোপে এদের এমন জর্জরিত অবস্থা ।
৪৬) এইসব দেবীগণ গঙ্গা আদি নদীবৃন্দ, আমার সেবা করার জন্যই এরা এসেছে । এইরূপ সাক্ষাৎ দেবীগণের দ্বারা সেবিত হয়েও আমার মনে শান্তি নেই ।
৪৭) হে তপোধন ! দয়া করে ধৈর্যপূর্বক আমার কাহিনী শুনুন । আমার কাহিনী যদিও জগতে সুবিদিত, তবুও তা শুনে আপনি আমাকে শান্তিপ্রদান করুন ।
৪৮) আমি দ্রাবিড় দেশে উৎপন্ন হয়ে কর্নাটকে বড় হয়েছি , মহারাষ্ট্রে কোথাও কোথাও আমি সম্মানিত হলেও গুজরাটে এসে আমি অশক্ত হয়ে পড়েছি ।
৪৯) সেখানে ঘোর কলিকালের প্রভাবে পাষন্ডগন আমার সর্বাঙ্গ ভেঙে দিয়েছে ।বহুকাল এই অবস্থায় থাকাতে আমার ছেলেরাও দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে ।
৫০) এরপর বৃন্দাবনে পৌঁছে আমি পরম রূপবতী যুবতীতে পরিণত হয়েছি ।
৫১) কিন্তু এইখানে শায়িত আমার দুই ছেলে পরিশ্রমবসত অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছে । আমি এখন এই স্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র যেতে চাই ।
৫২) এদের বৃদ্ধাবস্থা দেখে আমার বড় দুঃখ হচ্ছে । আমি নিজে তরুণী আর আমার দুই পুত্র বৃদ্ধ কেন ?
৫৩) আমরা তিনজন সর্বদা একসাথে থাকি, তাহলে এই বৈপরীত্য কেন ? বরং মা বৃদ্ধা হবে আর ছেলেরা তরুণ থাকবে এমনটাই তো হওয়া উচিত ।
৫৪) এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজের দুরাবস্থার জন্য শোক করছি । আপনি পরম বুদ্ধিমান এবং যোগ-নিধি । এর কারণ কি হতে পারে তা আমাকে বলুন ।
৫৫) নারদ বললেন - সাধ্বী ! আমি অন্তরের জ্ঞানদৃষ্টিতে তোমার সব দুঃখের কারণ দেখতে পাচ্ছি, তোমার দুঃখ করা উচিত নয় । ভগবান শ্রীহরি তোমার মঙ্গল করবেন ।
৫৬) সুত বললেন - মুনিবর দেবর্ষি নারদ মুহূর্তের মধ্যে এর কারণ জানলেন এবং বললেন ।
৫৭) নারদ বললেন - দেবী ! মন দিয়ে শোনো ! এখন দারুন কলিযুগ । তারফলে সদাচার, যোগমার্গ, তপস্যাদি সব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ।
৫৮) এই যুগে জীব শঠতা ও দুস্কর্মে লিপ্ত হয়ে অঘাসুর হয়ে গিয়েছে । এই সংসারে যেইদিকে তাকাবে দেখবে সৎপুরুষেরা দুঃখে ম্লান হয়ে রয়েছে আর দুষ্টের দল সুখে থেকে উন্নতি করছে । এই সময়ে যে সকল বুদ্ধিমান মানুষের ধৈর্য অটুট রয়েছে তারা জ্ঞানী ও পণ্ডিত ।
৫৯) এই পৃথিবী ক্রমে ক্রমে অনন্তনাগের উপর ভার হয়ে পড়ছে । এই পৃথিবী পাপের ভারে স্পর্শযোগ্যা তো নয়ই, এমনকি দর্শনেরও উপযুক্ত নয় , আর এতে মঙ্গলজনকও কিছু দেখা যাচ্ছে না ।
৬০) এখন সপুত্র তোমার প্রতি কেউ দৃষ্টিপাত করে না, বিষয় অনুরাগে অন্ধ জীবের দ্বারা উপেক্ষিত হয়ে তুমি জর্জরিত হয়ে রয়েছ ।
৬১) বৃন্দাবনে এসে পড়ার ফলে তুমি আবার নবীনা যুবতী হয়ে গিয়েছ । ধন্য এই বৃন্দাবন ধাম যেখানে ভক্তি সর্বদাই নৃত্য করে ।
৬২) কিন্তু তোমার এই দুই পুত্রের এখানে কোনো গুনগ্রাহী নেই, সেইজন্য এদের বৃদ্ধাবস্থা দূর হচ্ছে না । এখানে কিছু আত্মসুখ বা ভগবৎস্পর্শজনিত আনন্দ প্রাপ্তির ফলে এদের নিদ্রাচ্ছন্ন বোধ হচ্ছে ।
৬৩) ভক্তিদেবী বললেন - মহারাজ পরীক্ষিত এই পাপী কলিযুগ কে কেন থাকতে দিয়েছেন ? এর আসার ফলেই তো সব কিছুর সার কোথায় যেন হারিয়ে গেল ।
৬৪) পরম করুনাময় ভগবান শ্রীহরিই বা এইসব অনাচার কি রূপে সহ্য করছেন ? হে মুনিবর ! আমার এই সংশয় আপনি নিরসন করুন । আপনার কথায় আমি বড়ই শান্তি পেয়েছি ।
৬৫) নারদ বললেন - হে সাধ্বী ! যখন জিজ্ঞাসাই করলে তখন মন দিয়ে শোনো , আমি তোমাকে সবিস্তারে এর বর্ণনা করছি । তাতে তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে ।
৬৬) ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র যেদিন এই মর্তলোক ছেড়ে নিজের পরমধামে চলে গেলেন, সেইদিন থেকে এই মর্তে সাধনভজনে সর্বতোভাবে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কলিযুগ প্রবেশ করেছে ।
৬৭) দিগ্বিজয়ের সময়ে মহারাজ পরীক্ষিতের দৃষ্টিতে পড়লে কলিযুগ অতি দীনভাবে তার শরণ নিয়েছিল । মৌমাছির মতো সারগ্রাহী রাজা স্থির করলেন যে একে বধ করা আমার উচিত হবে না ।
৬৮) কারণ যোগসাধন, তপস্যা, বা সমাধি দ্বারা যে ফল লাভ করা যায় না, তা কলিযুগে কেবলমাত্র শ্রীহরির নামকীর্তনের মাধ্যমেই অতি উত্তমরূপে লাভ করা যায় ।
৬৯) এইরূপে সবদিক থেকে অসার হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র একটা দিকে সারযুক্ত হওয়াতে, কলিযুগে জন্মগ্রহণ করা জীবের মঙ্গলের উদেশ্যে পরীক্ষিত মহারাজ কলিকে আশ্রয় দিলেন।
৭০) এই যুগে কুকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে মানুষের সব কিছুরই সার নষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং পৃথিবীর সমস্ত জিনিস বীজহীন তুষের মতো হয়ে পড়েছে ।
৭১) ব্রাহ্মনেরা কেবলমাত্র অন্নধনাদির লোভে ঘরে ঘরে গিয়ে জনে জনে ভাগবত কথা শোনাচ্ছে, তারফলে কথার সারবস্তুই আর থাকছে না ।
৭২) তীর্থসকলে নানারকম অত্যন্ত ঘোর কুকর্মকারী, নাস্তিক ও নারকী সব মানুষ বাস করছে, আর এর ফলে তীর্থসকলের মাহাত্ম্যও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।
৭৩) যাদের চিত্ত নিরন্তর কাম, ক্রোধ, অতিশয় লোভ এবং বিষয় তৃষ্ণায় তাপিত হচ্ছে, তারাও তপস্যার ভান করছে, যার ফলে তপস্যারও সারভাগ নষ্ট হয়ে গিয়েছে ।
৭৪) নিজের মনকে বশীভূত না করে লোভ, দম্ভ ও পাষন্ডাচারের আশ্রয় নেওয়ায় এবং শাস্ত্রের অধ্যয়ন না করার ফলে ধ্যানযোগের ফল নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে ।
৭৫) পন্ডিত বিদ্বানদের আজ এমন দশা যে তারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে মহিষের মতন রতিক্রিয়া করছে । শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেই তারা দক্ষ কিন্তু মুক্তির সাধনে তারা সর্বতোভাবে অযোগ্য হয়ে উঠেছে ।
৭৬) সম্প্রদায়গতভাবে প্রাপ্ত বৈষ্ণবের লক্ষণও কোথাও দেখা যায় না । এইভাবে সর্বত্রই সকল কিছুর সারভাগ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ।
৭৭) এ যুগের এটাই স্বভাব, এতে কারোর দোষ নেই, সেইজন্য ভগবান পুণ্ডরীকাক্ষ অত্যন্ত কাছে থাকা সত্ত্বেও সব সহ্য করছেন ।
৭৮) সুত বললেন - হে শৌনক ! দেবর্ষি নারদের এইসব কথা শুনে ভক্তি বড়ই বিস্মিত হলেন, তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা শোনো ।
৭৯) ভক্তি বলেন - হে দেবর্ষি ! আপনি ধন্য ! আমার অতীব সৌভাগ্য যে আপনি এখানে এসেছেন । সংসারে সাধুর দর্শনই সমস্ত সিদ্ধি-লাভের পরম কারণ ।
৮০) আপনার উপদেশ কেবল একবারমাত্র গ্রহণ করেই কয়াধু-কুমার প্রহ্লাদ মায়াকে জয় করেছিল । ধ্রুবও আপনারই কৃপায় ধ্রুবপদ লাভ করেছিল । আপনি সর্বমঙ্গলময় এবং সাক্ষাৎ ব্রহ্মার পুত্র, আমি আপনাকে প্রণাম করছি ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই,আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগল তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
ভগবান শ্রীহরি
|| ওম নমঃ ভগবতে বাসুদেবায় ||
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ -প্রথম অধ্যায়
দেবর্ষি নারদের ভক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকার
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা স্বয়ং শ্রীভগবান কর্তৃক ব্রহ্মাকে বর্ণিত শ্রীমদ্ভাগবত মাহাত্ম্য সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা মূল শ্রীমদ্ভাগবত শুরু করব । এটি শুরু হয় শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের প্রথম অধ্যায় , দেবর্ষি নারদের ভক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গের সাথে ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
২) মহর্ষি ব্যাসদেব এর সুপুত্র, মহাজন শুকদেবের তখনও উপনয়ন সংস্কার হয়নি, অর্থাৎ তার লৌকিক বৈদিক সমস্ত কর্মানুষ্ঠান তখনও বাকি, এমতাবস্থায় তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প নিয়ে একাকী গৃহত্যাগে উদ্যোগী হয়েছেন । তাই দেখে তাঁর পিতা মহর্ষি ব্যাসদেব পুত্রবিরহে, কাতরস্বরে বলে উঠলেন - হে পুত্র ! তুমি কোথায় চলেছ ? সেই সময় তন্ময় হওয়ার ফলে বৃক্ষরাজি শুকদেবের হয়ে উত্তর দিয়েছিল । এইরূপ সর্বভূত-হৃদয়স্বরূপ শুকদেবমুনিকে আমি প্রণাম করি ।
৩) একদা ভাগবতকথামৃত রসাস্বাদনকুশল মুনিবর শৌনক নৈমিষারণ্যক্ষেত্রে বিরাজমান মহামতি সুতকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলেন ।
৪) শৌনক বললেন - হে সুত ! অজ্ঞান অন্ধকার দূরীকরণে আপনার জ্ঞান কোটি সূর্যদেবের ন্যায় প্রভাময় । আপনি আমাদের কর্ণের তৃপ্তিবিধানকারী এবং অমৃতস্বরূপ সারগর্ভ কথা বলুন ।
৫) ভক্তি, জ্ঞান, ও বৈরাগ্য দ্বারা লভ্য মহান বিবেকের বিকাশ কি রূপে হয় এবং বৈষ্ণবগণ কি প্রকারে জগতের এই সর্বপ্রকার মায়া-মোহ থেকে নিজেদের মুক্ত করেন ?
৬) এই ঘোর কলিকালে জীব প্রায়শই আসুরিক স্বভাবসম্পন্ন হয়েছে, নানাবিধ ক্লেশে ক্লিষ্ট এই জীবসমূহকে পরিশুদ্ধ করার সর্বশ্রেষ্ট উপায় কি ?
৭) হে সুত ! আপনি এমন কোনো শাশ্বত সাধন-পথের সন্ধান দিন, যা সর্বাপেক্ষা কল্যাণকারী এবং পবিত্রকর, আর যার দ্বারা পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায় ।
৮) চিন্তামণি কেবলমাত্র লৌকিক সুখই দিতে পারে আর কল্পবৃক্ষ বড়োজোর স্বর্গীয় সম্পদাদি দিতে পারে, কিন্তু গুরুদেব প্রসন্ন হলে শ্রীভগবানের যোগীদুর্লভ নিত্য শ্রী বৈকুণ্ঠধাম দিতে পারেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
১০) আমি তোমাকে ভক্তিপ্রবাহ বৃদ্ধিকারী এবং সচ্চিদানন্দস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতা অর্জনকারী সাধনের কথা বলবো ; মন দিয়ে শোনো ।
১১) মহর্ষি শুকদেব এই ঘোর কলিযুগে জীবকে কালরুপী সর্পের গ্রাসে পতিত হওয়ার মহাভয় থেকে রক্ষা করার জন্য শ্রীমদ্ভাগবত-শাস্ত্রের প্রবচন করেছেন।
১২) মানবের চিত্তশুদ্ধির জন্য এর থেকে মঙ্গলকারী আর কোনো সাধন নেই । কোটি কোটি জন্মজন্মান্তরের পুণ্যের উদয় হলে তবেই মানুষের এই ভাগবত শাস্ত্রের প্রাপ্তি হয় ।
১৩) রাজা পরীক্ষিৎকে এই ভাগবতকথা শোনাবার জন্য মহর্ষি শুকদেব যখন সভায় সমাসীন ছিলেন, তখন অমৃতকুম্ভ হাতে নিয়ে দেবতারা তাঁর কাছে আসেন ।
১৪) নিজেদের কার্যসিদ্ধিতে অতীব কুশল দেবতারা মহর্ষি শুকদেবকে প্রণাম করে বললেন - আপনি এই অমৃতকুম্ভ গ্রহণ করে তার পরিবর্তে আপনার কথামৃত আমাদের প্রদান করুন ।
১৫) এই প্রকারে আমরা পরস্পরের মধ্যে কথামৃত এবং অমৃত বিনিময় করার মাধ্যমে , মহারাজ পরীক্ষিৎ অমৃত পান করতে থাকুন আর আমরা দেবতারা সকলে শ্রীমদ্ভাগবতরূপ অমৃত পান করি ।
১৬) এই সংসারে কাঁচ আর মহামূল্য মনি যেমন, ঠিক তেমনি কোথায় অমৃত আর কোথায় ভাগবতকথা ! এই চিন্তা করে মহর্ষি শুকদেব দেবতাদের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন ।
১৭) দেবতাদের কথা শ্রবনে অনধিকারী, ভক্তিহীন বুঝতে পেরে মহর্ষি শুকদেব তাদের এই ভাগবতকথামৃত দেননি, এই কারণে শ্রীমদ্ভাগবতকথা দেবতাদেরও দুর্লভ বলা হয় ।
১৮) পুরাকালে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবনের ফলে মহারাজ পরীক্ষিৎকে মোক্ষলাভ করতে দেখে স্বয়ং ব্রহ্মাও বিস্মিত হয়েছিলেন । তিনি সত্যলোকে সকল প্রকার সাধনকে ওজনে বিচার করেছিলেন ।
১৯) ওজনে ভাগবতই নিজ মাহাত্ম্যে অপর সব সাধন অপেক্ষা ভারী হয় । তা দেখে মুনি-ঋষিরা সকলেই চমৎকৃত হন ।
২০) তারা এই সিদ্ধান্ত করলেন যে কলিযুগে ভগবতস্বরূপ এই ভাগবতশাস্ত্রেরই পাঠ এবং শ্রবণে তাৎক্ষণিক মোক্ষপ্রাপ্তি সম্ভব ।
২১) সপ্তাহ-বিধি অনুসারে শ্রবণে শ্রীমদ্ভাগবতশাস্ত্র নিশ্চিত ভক্তি প্রদান করে । পুরাকালে দয়ালু সনকাদি মুনিগণ দেবর্ষি নারদকে এই পুন্যশাস্ত্র শ্রবণ করিয়েছিলেন ।
২২) যদিও দেবর্ষি নারদ পূর্বেই ব্রহ্মার নিকট এই শাস্ত্র শ্রবণ করেন তবুও সপ্তাহ-শ্রবণের বিধি সনকাদি ঋষিগণই তাঁকে বলেছিলেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
২৪) সুত বললেন - আমি এখন তোমাকে সেই ভক্তিমূলক কথা শোনাচ্ছি , যে কথা মহর্ষি শুকদেব তার শিষ্যগণের মধ্যে, আমাকে যোগ্য বিবেচনা করে একান্তে শ্রবণ করিয়েছিলেন ।
২৫) একদা এই চারজন পবিত্র বাল-ঋষিগণ বিশাল নগরী তে এসেছিলেন সৎসঙ্গ করার উদ্দেশ্যে । সেখানে তারা দেবর্ষি নারদকে দেখতে পান ।
২৬) সনকাদি মুনিগন দেবর্ষি নারদকে প্রশ্ন করলেন - হে ব্রহ্মন্ ! আপনাকে এত ব্যাকুল দেখাচ্ছে কেন ? এত কি চিন্তা করছেন ? এত দ্রুত চলেছেনই বা কোথায় ? এবং আপনি এলেনই বা কোথা থেকে ?
২৭) আপনাকে হৃতসর্বস্ব ব্যক্তির মতন ব্যকুল দেখাচ্ছে । আপনার মতন নিরাসক্ত পুরুষের পক্ষে এইরকম ব্যাকুলতা শোভা পায় না । এর কারণ কি বলুন ?
২৮-৩০) নারদ বললেন - এই ভুলোককে সর্বশ্রেষ্ঠ লোক মনে করে আমি এখানে এসেছি । এখানে আমি পুষ্কর, প্রয়াগ, কাশী, গোদাবরী, হরিদ্বার, কুরুক্ষেত্র, শ্রীরঙ্গ, সেতুবন্ধ রামেশ্বরাদি, প্রভৃতি তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করেছি; কিন্তু কোথাও মনের শান্তি পেলাম না । অধর্মের পরম সহায়ক কলিযুগ বর্তমানে এই পৃথিবীকে আষ্টেপিষ্টে ক্লিষ্ট করে রেখেছে ।
৩১-৩৩) এখন এখানে সত্য, তপস্যা, শৌচ ( পবিত্রতা ), দয়া, দান কিছুরই অবশিষ্ট নেই । হতভাগ্য জীবগণ কেবলমাত্র নিজ নিজ উদরপূর্তির চিন্তাতেই মগ্ন । তারা অসত্যভাষী, অলস, মন্দবুদ্ধি, ভাগ্যহীন ও উপদ্রবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । যাদের সাধু-সন্ত বলা হয় তারা সকলেই পাষন্ড আচারনিরত হয়ে গিয়েছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের বৈরাগী মনে হলেও স্ত্রীধনাদী তারা নির্বিকারেই গ্রহণ করে । বাড়িতে কেবলই স্ত্রীরাজত্ব, শ্যালকগণই প্রধান পরামর্শদাতা, লোকেরা লোভে বশীভূত হয়ে কন্যাবিক্রয় করে এবং স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে নিত্য কলহ লেগেই আছে ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
৩৫) বর্তমানে ভূতলে না আছে কোনো যোগী না কোনো সিদ্ধপুরুষ, না আছে কোনো জ্ঞানী পুরুষ, না আছে কোনো সৎকর্মপরায়ণ মানুষ । যা কিছু সাধন ছিল তা এই কলিরূপ দাবানলে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে ।
৩৬) এই কলিযুগে প্রায় সকলেই অন্ন বিক্রয় করছে, ব্রাম্ভনেরা অর্থের বিনিময়ে বেদশিক্ষা দিচ্ছে আর স্ত্রীলোকেরা বেশ্যাবৃত্তির দ্বারা জীবীকা নির্বাহ করছে ।
৩৭) এইরূপ কলির দোষসকল দেখতে দেখতে পৃথিবী পরিভ্রমণকালে আমি যমুনা তীরে সচ্চিদানন্দস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমিতে উপস্থিত হই ।
৩৮) হে মুনিগন ! শুনুন, আমি সেখানে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম । একজন যুবতী স্ত্রী বিষন্ন মনে বসেছিল ।
৩৯) তার পাশে দুইজন অচেতন বৃদ্ধ পুরুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল । সেই স্ত্রীলোকটি কখনও তাদের শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছিল আবার কখনও তাদের সামনে ক্রন্দন করছিল ।
৪০) ওই অবস্থায় সে তার শরীরের রক্ষক পরমাত্মাকে দশদিকে দর্শন করছিল, শত শত নারী তাকে ঘিরে হাওয়া করছিল আর প্রবোধ দিচ্ছিল ।
৪১) দূর থেকে এই ঘটনা লক্ষ্য করে আমি কৌতূহলের বশে ওই যুবতীর কাছে গেলাম, আমাকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল আর অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগল।
৪২) যুবতীটি বলল - হে মহাত্মন ! কৃপাকরে এই স্থলে ক্ষণমাত্র অবস্থান করুন এবং আমাকে দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত করুন । আপনার দর্শনে মানুষের সকল পাপের নিবৃত্তি হয় ।
৪৩) আপনার উপদেশবাক্যে আমার দুঃখেরও শান্তি হবে, বহু ভাগ্যে আপনার দর্শন প্রাপ্তি হয় ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
৪৫) যুবতীটি বলল - আমার নাম ভক্তি, এই দুইজন পুরুষ আমার দুই ছেলে জ্ঞান ও বৈরাগ্য । কালের প্রকোপে এদের এমন জর্জরিত অবস্থা ।
৪৬) এইসব দেবীগণ গঙ্গা আদি নদীবৃন্দ, আমার সেবা করার জন্যই এরা এসেছে । এইরূপ সাক্ষাৎ দেবীগণের দ্বারা সেবিত হয়েও আমার মনে শান্তি নেই ।
৪৭) হে তপোধন ! দয়া করে ধৈর্যপূর্বক আমার কাহিনী শুনুন । আমার কাহিনী যদিও জগতে সুবিদিত, তবুও তা শুনে আপনি আমাকে শান্তিপ্রদান করুন ।
৪৮) আমি দ্রাবিড় দেশে উৎপন্ন হয়ে কর্নাটকে বড় হয়েছি , মহারাষ্ট্রে কোথাও কোথাও আমি সম্মানিত হলেও গুজরাটে এসে আমি অশক্ত হয়ে পড়েছি ।
৪৯) সেখানে ঘোর কলিকালের প্রভাবে পাষন্ডগন আমার সর্বাঙ্গ ভেঙে দিয়েছে ।বহুকাল এই অবস্থায় থাকাতে আমার ছেলেরাও দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে ।
৫০) এরপর বৃন্দাবনে পৌঁছে আমি পরম রূপবতী যুবতীতে পরিণত হয়েছি ।
৫১) কিন্তু এইখানে শায়িত আমার দুই ছেলে পরিশ্রমবসত অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছে । আমি এখন এই স্থান পরিত্যাগ করে অন্যত্র যেতে চাই ।
৫২) এদের বৃদ্ধাবস্থা দেখে আমার বড় দুঃখ হচ্ছে । আমি নিজে তরুণী আর আমার দুই পুত্র বৃদ্ধ কেন ?
৫৩) আমরা তিনজন সর্বদা একসাথে থাকি, তাহলে এই বৈপরীত্য কেন ? বরং মা বৃদ্ধা হবে আর ছেলেরা তরুণ থাকবে এমনটাই তো হওয়া উচিত ।
৫৪) এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজের দুরাবস্থার জন্য শোক করছি । আপনি পরম বুদ্ধিমান এবং যোগ-নিধি । এর কারণ কি হতে পারে তা আমাকে বলুন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
৫৬) সুত বললেন - মুনিবর দেবর্ষি নারদ মুহূর্তের মধ্যে এর কারণ জানলেন এবং বললেন ।
৫৭) নারদ বললেন - দেবী ! মন দিয়ে শোনো ! এখন দারুন কলিযুগ । তারফলে সদাচার, যোগমার্গ, তপস্যাদি সব বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ।
৫৮) এই যুগে জীব শঠতা ও দুস্কর্মে লিপ্ত হয়ে অঘাসুর হয়ে গিয়েছে । এই সংসারে যেইদিকে তাকাবে দেখবে সৎপুরুষেরা দুঃখে ম্লান হয়ে রয়েছে আর দুষ্টের দল সুখে থেকে উন্নতি করছে । এই সময়ে যে সকল বুদ্ধিমান মানুষের ধৈর্য অটুট রয়েছে তারা জ্ঞানী ও পণ্ডিত ।
৫৯) এই পৃথিবী ক্রমে ক্রমে অনন্তনাগের উপর ভার হয়ে পড়ছে । এই পৃথিবী পাপের ভারে স্পর্শযোগ্যা তো নয়ই, এমনকি দর্শনেরও উপযুক্ত নয় , আর এতে মঙ্গলজনকও কিছু দেখা যাচ্ছে না ।
৬০) এখন সপুত্র তোমার প্রতি কেউ দৃষ্টিপাত করে না, বিষয় অনুরাগে অন্ধ জীবের দ্বারা উপেক্ষিত হয়ে তুমি জর্জরিত হয়ে রয়েছ ।
৬১) বৃন্দাবনে এসে পড়ার ফলে তুমি আবার নবীনা যুবতী হয়ে গিয়েছ । ধন্য এই বৃন্দাবন ধাম যেখানে ভক্তি সর্বদাই নৃত্য করে ।
৬২) কিন্তু তোমার এই দুই পুত্রের এখানে কোনো গুনগ্রাহী নেই, সেইজন্য এদের বৃদ্ধাবস্থা দূর হচ্ছে না । এখানে কিছু আত্মসুখ বা ভগবৎস্পর্শজনিত আনন্দ প্রাপ্তির ফলে এদের নিদ্রাচ্ছন্ন বোধ হচ্ছে ।
৬৩) ভক্তিদেবী বললেন - মহারাজ পরীক্ষিত এই পাপী কলিযুগ কে কেন থাকতে দিয়েছেন ? এর আসার ফলেই তো সব কিছুর সার কোথায় যেন হারিয়ে গেল ।
৬৪) পরম করুনাময় ভগবান শ্রীহরিই বা এইসব অনাচার কি রূপে সহ্য করছেন ? হে মুনিবর ! আমার এই সংশয় আপনি নিরসন করুন । আপনার কথায় আমি বড়ই শান্তি পেয়েছি ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
৬৫) নারদ বললেন - হে সাধ্বী ! যখন জিজ্ঞাসাই করলে তখন মন দিয়ে শোনো , আমি তোমাকে সবিস্তারে এর বর্ণনা করছি । তাতে তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে ।
৬৬) ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র যেদিন এই মর্তলোক ছেড়ে নিজের পরমধামে চলে গেলেন, সেইদিন থেকে এই মর্তে সাধনভজনে সর্বতোভাবে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কলিযুগ প্রবেশ করেছে ।
৬৭) দিগ্বিজয়ের সময়ে মহারাজ পরীক্ষিতের দৃষ্টিতে পড়লে কলিযুগ অতি দীনভাবে তার শরণ নিয়েছিল । মৌমাছির মতো সারগ্রাহী রাজা স্থির করলেন যে একে বধ করা আমার উচিত হবে না ।
৬৮) কারণ যোগসাধন, তপস্যা, বা সমাধি দ্বারা যে ফল লাভ করা যায় না, তা কলিযুগে কেবলমাত্র শ্রীহরির নামকীর্তনের মাধ্যমেই অতি উত্তমরূপে লাভ করা যায় ।
৬৯) এইরূপে সবদিক থেকে অসার হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র একটা দিকে সারযুক্ত হওয়াতে, কলিযুগে জন্মগ্রহণ করা জীবের মঙ্গলের উদেশ্যে পরীক্ষিত মহারাজ কলিকে আশ্রয় দিলেন।
৭০) এই যুগে কুকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে মানুষের সব কিছুরই সার নষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং পৃথিবীর সমস্ত জিনিস বীজহীন তুষের মতো হয়ে পড়েছে ।
৭১) ব্রাহ্মনেরা কেবলমাত্র অন্নধনাদির লোভে ঘরে ঘরে গিয়ে জনে জনে ভাগবত কথা শোনাচ্ছে, তারফলে কথার সারবস্তুই আর থাকছে না ।
৭২) তীর্থসকলে নানারকম অত্যন্ত ঘোর কুকর্মকারী, নাস্তিক ও নারকী সব মানুষ বাস করছে, আর এর ফলে তীর্থসকলের মাহাত্ম্যও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।
৭৩) যাদের চিত্ত নিরন্তর কাম, ক্রোধ, অতিশয় লোভ এবং বিষয় তৃষ্ণায় তাপিত হচ্ছে, তারাও তপস্যার ভান করছে, যার ফলে তপস্যারও সারভাগ নষ্ট হয়ে গিয়েছে ।
৭৪) নিজের মনকে বশীভূত না করে লোভ, দম্ভ ও পাষন্ডাচারের আশ্রয় নেওয়ায় এবং শাস্ত্রের অধ্যয়ন না করার ফলে ধ্যানযোগের ফল নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্ - প্রথম অধ্যায় |
৭৬) সম্প্রদায়গতভাবে প্রাপ্ত বৈষ্ণবের লক্ষণও কোথাও দেখা যায় না । এইভাবে সর্বত্রই সকল কিছুর সারভাগ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ।
৭৭) এ যুগের এটাই স্বভাব, এতে কারোর দোষ নেই, সেইজন্য ভগবান পুণ্ডরীকাক্ষ অত্যন্ত কাছে থাকা সত্ত্বেও সব সহ্য করছেন ।
৭৮) সুত বললেন - হে শৌনক ! দেবর্ষি নারদের এইসব কথা শুনে ভক্তি বড়ই বিস্মিত হলেন, তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা শোনো ।
৭৯) ভক্তি বলেন - হে দেবর্ষি ! আপনি ধন্য ! আমার অতীব সৌভাগ্য যে আপনি এখানে এসেছেন । সংসারে সাধুর দর্শনই সমস্ত সিদ্ধি-লাভের পরম কারণ ।
৮০) আপনার উপদেশ কেবল একবারমাত্র গ্রহণ করেই কয়াধু-কুমার প্রহ্লাদ মায়াকে জয় করেছিল । ধ্রুবও আপনারই কৃপায় ধ্রুবপদ লাভ করেছিল । আপনি সর্বমঙ্গলময় এবং সাক্ষাৎ ব্রহ্মার পুত্র, আমি আপনাকে প্রণাম করছি ।
। ইতি শ্রীপদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে শ্রীমদ্ভগবতমাহাত্ম্যে ভক্তিনারদসমাগমো নাম প্রথমোহধ্যায়ঃ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই,আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ||
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগল তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
Khub bhalo Lekha.Thank you for this.
ReplyDeleteজয় রাধেশ্যাম
ReplyDeletejoy radhe radha krisna
ReplyDelete