Bhagavatam,Srimad Bhagavatam, Bhagavata Purana, Srimad Bhagavatam in Bengali,
Bhagavata Purana in Bengali, Bhagavata Mahapurana, Sanatana Dharma,
Bhagavata Mahapurana, Srimad Bhagavatam Bangla, Gita, শ্রীমদ্ ভাগবতম,
শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরান, শ্রীমদ্ ভাগবত পুরান, Srimad Bhagavatam online, শ্রীমদ ভাগবত,ভাগবত মহাপুরান , ধুন্ধুকারীর প্রেতযোনি প্রাপ্তি এবং তা থেকে মুক্তি , শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় , Srimad Bhagavatam Mahatmyam Chapter 5
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের চতুর্থ অধ্যায়, গোকর্ণ উপাখ্যান সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের পঞ্চম অধ্যায়, ধুন্ধুকারীর প্রেতযোনি প্রাপ্তি এবং তা থেকে মুক্তি সম্পর্কে জানবো । এটি শুরু হয় সুত দ্বারা বর্ণিত দেবর্ষি নারদের সাথে সনকাদি মুনিগণের কথোপকথন এর মাধ্যমে ।
১) সুত বললেন - হে মুনিবর শৌনক ! ধুন্ধুকারীর পিতা আত্মদেব যখন অরণ্যবাসী হলেন তখন ধুন্ধুকারী তার জননীকে প্রচন্ড প্রহারপূর্বক বলল - সঞ্চিত অর্থ সকল কোথায় রেখেছ বল , নচেৎ এখনই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব ।
২) ধুন্ধুলী এই ধমকানিতে ভয় পেয়ে এবং ছেলে ধুন্ধুকারীর অত্যাচারে সন্ত্রস্ত হয়ে সেই রাত্রে কূপে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করল ।
৩) যোগারূঢ় গোকর্ণ তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । এই ঘটনাতে তার মনের মধ্যে কোনপ্রকার সুখ বা দুঃখ অনুভূত হল না ; কারণ তাঁর কোনো শত্রু বা মিত্র কিছুই ছিল না ।
৪) পাঁচটি কুলটা মেয়ে ( বেশ্যা ) নিয়ে ধুন্ধুকারী বাড়িতে বসবাস করতে থাকল । সেই কুলটা মেয়েদের জন্য ভোগ্যবস্তু জোগাড়ের চিন্তাতে তার বুদ্ধিভ্রম হল এবং সে নানানরকম অত্যুগ্র ( ক্রুর , খারাপ ) কর্ম করতে লাগল ।
৫) সেই কুলটা মেয়েরা একদিন তার কাছ থেকে অনেক গহনা চেয়ে বসল । ধুন্ধুকারী তো কামনার বশে উন্মত্ত হয়েই ছিল, এমনকি মৃত্যুর চিন্তাও কখনও হত না তার । সেই গহনা জোগাড় করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ।
৬) ধুন্ধুকারী বিভিন্ন জায়গায় চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অনেক অর্থ বাড়ি নিয়ে এলো । তারপর কিছু সুন্দর আভূষণ ( গহনা ) এবং সুন্দর সুন্দর বস্ত্র এনে ওই পাঁচ জন কে দিল ।
৭) চুরি করা প্রচুর ধনসম্পদ দেখে এক রাত্রে সেই পাঁচ বেশ্যারা যুক্তি করলো যে ' এই ধুন্ধুকারী তো প্রত্যহই চুরি করে , ফলে একদিন না একদিন হোক রাজার লোকেরা নিশ্চয়ই একে ধরে নিয়ে যাবে ।
৮) তখন রাজা এই সব ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে একে নিশ্চয়ই প্রাণদন্ড দেবে । সুতরাং একে যখন একদিন সেই মরতেই হবে তাহলে আমরাই একে গোপনে হত্যা করি না কেন এই ধনসম্পত্তির জন্য ।
৯-১০) একে হত্যা করে এর এই সব সম্পদ নিয়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব ।' এই চিন্তা করে তারা ধুন্ধুকারীকে ঘুমন্ত অবস্থায় রশ্মি ( দড়ি ) দিয়ে বেঁধে তার গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করল । এরপরেও যখন ধুন্ধুকারী মরল না , সেটা দেখে তারা চিন্তাতুরা হয়ে পড়ল ।
১১) তখন তারা ধুন্ধুকারীর গলার মধ্যে জ্বলন্ত অঙ্গার ঢুকিয়ে দিল এবং ওই আগুনের জ্বালায় ছটপট করতে করতে ধুন্ধুকারীর মৃত্যু হল ।
১২) ওই বেশ্যারা ধুন্ধুকারীর দেহটা একটা গর্তের মধ্যে পুরে মাটি চাপা দিয়ে দিল । আসলে অসৎ নারীরা এইরকমই দুঃসাহসী হয় । তাদের এই দুষ্কর্মের সংবাদ কেউই জানল না ।
১৩) লোকেরা তাদের ধুন্ধুকারীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল - আমাদের প্রিয়তম এবার অর্থের সন্ধানে বহু দূরদেশে গিয়েছেন । এক বছরের মধ্যেই তিনি ফিরে আসবেন ।
১৪) বুদ্ধিমান মনুষ্যদের কখনও এইপ্রকার দুষ্টা নারীদের বিশ্বাস করা উচিত নয় । যে সকল মূঢ় ব্যক্তিরা এদের কথা বিশ্বাস করে তাদের অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয় ।
১৫) এদের রসময়ী কথা কামুকদের হৃদয়ে অমৃতরসের সঞ্চার করে কিন্তু এদের হৃদয় শানিত ক্ষুরের ন্যায় তীক্ষ্ণ হয় । সুতরাং এই সকল নারীরা কাদের প্রতিই বা আসক্ত হবে ?
১৬) সেইসকল বেশ্যারা ধুন্ধুকারীর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করল; তাদের এইরূপ স্বামী আরও কত ছিল । এদিকে ধুন্ধুকারী নিজের অতীব কুকর্মের পরিনামবশত ভয়ঙ্করপ্রেতযোনি প্রাপ্ত হল ।
১৭-১৮) সে ভীষণ ঝড়ের রূপ ধরে নিত্যই দশদিক উত্যক্ত করে বেড়াত । শীত-গ্রীষ্মে জর্জরিত হয়ে ও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে নিজের পরিণতির উপর সর্বদাই হা-হুতাশ করত । কিছুকাল পরে গোকর্ণও লোকমুখে ধুন্ধুকারীর মৃত্যুসংবাদ পেলেন ।
১৯) তখন ধুন্ধুকারীকে অনাথ বিবেচনা করে গোকর্ণ গয়াতীর্থে গিয়ে তার শ্রাদ্ধনুষ্ঠান সমাপন করলেন এবং অন্যান্য যে সকল তীর্থে তিনি যেতেন সেই সকল তীর্থেও আবশ্যকীয় শ্রাদ্ধ-ক্রিয়াদি করলেন ।
২০) এইভাবে ভ্রমণ করতে করতে একদিন গোকর্ণ নিজের গৃহে এলেন এবং সবার অলক্ষ্যে বাড়ির আঙিনায় রাত্রিবাস করতে নিশ্চয় করলেন ।
২১) সেই স্থলে নিজের ভ্রাতাকে রাত্রে নিদ্রারত অবস্থায় দেখে ধুন্ধুকারী তাকে নিজের মহাভয়ঙ্কর রূপ দেখাল ।
২২) কখনও ভেড়া , কখনও হস্তী , কখনও মহিষ , কখনও ইন্দ্র , কখনও বা অগ্নির রূপ ধারণ করল । শেষকালে সে আবার মনুষ্যরূপে দেখা দিল ।
২৩) এইসকল বৈপরীত্যপূর্ণ অসাধারণ সব ব্যাপার দেখে গোকর্ণ স্থির করলেন যে এ নিশ্চয়ই কোনও দুর্গতিপ্রাপ্ত । তখন তিনি ধৈর্যপূর্বক তাকে জিজ্ঞেস করলেন ।
২৪) গোকর্ণ জিজ্ঞেস করলেন যে - তুমি কে ? রাত্রিবেলায় আমাকে এইসব ভয়ানক রূপ দেখাচ্ছ কেন ? তুমি এই দশাপ্রাপ্তই বা হলে কিভাবে ? আমাকে ঠিক করে বল - তুমি প্রেত , পিশাচ না রাক্ষস ?
২৫) সুত বললেন - গোকর্ণর এইরকম প্রশ্ন করাতে সে পুনঃ পুনঃ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করতে লাগল । তার কথা বলার সামর্থ ছিল না । তাই সে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল ।
২৬) গোকর্ণ তখন গণ্ডূষে জল নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে সেই মন্ত্রপূত জল তার গায়ে ছিটিয়ে দিলেন । এতে তার কিছু পাপ বিনষ্ট হল , আর তারফলে সে বলতে লাগল ।
২৭) প্রেত বলল - ' আমি তোমার ভ্রাতা । আমার নাম ধুন্ধুকারী । নিজের কৃতকর্মের দোষেই আমি নিজের ব্রাহ্মণত্বের নাশ করেছি ।
২৮) আমার কুকর্মের কোনো সীমা পরিসীমা নেই । আমি ভীষণ অজ্ঞানান্ধকারে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম । আমি অনেক হিংসাবৃত্তি করেছি এবং তা অনেক মানুষের হানি করেছে । অবশেষে স্ত্রীবেশী ওই কুলটা নারীগুলো আমাকে হত্যা করেছে ।
২৯) এর ফলস্বরূপ আমি প্রেতযোনিতে পতিত হয়ে এই দুর্দশা ভোগ করছি । বর্তমানে দৈববশে কর্মফলের উদয় হওয়ার জন্য আমি কেবল বায়ুপান করে জীবনধারণ করছি ।
৩০) ভ্রাতা গোকর্ণ ! তুমি তো কৃপাসিন্ধু , আমার অশ্রুমোচন করে তুমি শীঘ্রই আমাকে এই প্রেতযোনি থেকে মুক্ত করো । ' গোকর্ণ ধুন্ধুকারীর সব কথা শুনলেন এবং এই কথা বললেন ।
৩১) গোকর্ণ বিস্ময়ের সাথে বললেন - হে ভ্রাতা ! এই বিষয়টা বড়ই বিচিত্রকর - আমি গয়াতে শাস্ত্রমতে তোমার পিন্ড অর্পণ করেছি , তবুও তুমি প্রেতযোনি থেকে উদ্ধার পাওনি !
৩২) গয়াশ্রাদ্ধতেও যদি তোমার মুক্তি না হয়ে থাকে তাহলে তো আমি আর কোনো উপায়ই দেখছি না । তুমি আমাকে সব কথা বিস্তারপূর্বক বল - এখন আমার কি করা বিধেয় (কর্তব্য) ?
৩৩) প্রেত বলল - শত গয়াশ্রাদ্ধতেও আমার মুক্তিলাভ হবে না । তুমি আমার মুক্তিলাভের অন্য কোনো উপায়ের বিচার করো ।
৩৪) প্রেতের এই কথা শুনে গোকর্ণ বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হলেন । তিনি বললেন ' শত গয়াশ্রাদ্ধতেও যদি তোমার এই প্রেতযোনি থেকে মুক্তি না হয় তবে তো তোমার উদ্ধারের পথ অসম্ভব বলে প্রতিত হচ্ছে ।
৩৫) আচ্ছা তুমি এখন নির্ভয়ে স্বস্থানে থাক , আমি বিচার বিবেচনা করে তোমার উদ্ধারের কোনো উপায় করবো ।'
৩৬) গোকর্ণের নির্দেশমতো ধুন্ধুকারী সেই স্থান থেকে নিজের জায়গায় চলে গেল । এদিকে গোকর্ণ সমস্ত রাত্রি এই ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করলেন কিন্তু কোনো উপায়ই তিনি খুঁজে পেলেন না ।
৩৭) প্রাতঃকালে ওইস্থলে গোকর্ণকে দেখে সকলেই খুশি হয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন । গোকর্ণ তখন সেখানে সমবেত সকলকেই পূর্বরাত্রের ঘটনা সম্পর্কে অবগত করালেন ।
৩৮) তাদের মধ্যে যারা বিদ্বান, যোগনিষ্ঠ , জ্ঞানী ও বেদজ্ঞ ছিলেন তারাও সকলেই অনেক শাস্ত্রবিচার করলেন , তথাপি ধুন্ধুকারীর মুক্তির উপায়ের কোনো পথ পাওয়া গেল না ।
৩৯) এমতাবস্থায় সেখানে উপস্থিত সকলেই এই সিদ্ধান্ত করলেন যে , এই বিষয়ে সূর্যদেব যা বিধান দেবেন তাই কর্তব্য । গোকর্ণ তখন আপন তপোবলের প্রভাবে সূর্যবেদবের গতি স্তব্ধ করে দিলেন ।
৪০-৪১) তারপর তিনি সূর্যদেবের যথাযত স্তুতিকরে বললেন - ' হে ভগবান ! আপনি সমগ্র জগতের সাক্ষী , আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন । আপনি অনুগ্রহপূর্বক ধুন্ধুকারীর উদ্ধারের উপায় সম্পর্কে আমাদের অবগত করান । ' গোকর্ণের এই প্রার্থনা শুনে সূর্যদেব স্পষ্ট করে বললেন - ' শ্রীমদ্ভাগবতে মুক্তি হতে পারে । তাই তুমি ধুন্ধুকারীর মুক্তির উদেশ্যে শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহপারায়ণ করো ।' ভগবান সূর্যদেবের এই ধর্মবাক্য সকলেই শুনতে পেলেন ।
৪২) তখন সকলেই বললেন ' নিষ্ঠাপূর্বক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করো , আর এর অনুষ্ঠানও অতি সরল । ' তখন গোকর্ণও সেই অনুযায়ী মনস্থির করে শ্রীমদ্ভাগবত সপ্তাহ পারায়ণের প্রস্তুতি নিলেন ।
৪৩) সেই ভাগবত কথা শ্রবণের জন্য নানাদেশ , গ্রামগঞ্জ থেকে অনেকে উপস্থিত হলেন । অনেক পঙ্গু , অন্ধ , বৃদ্ধ , মন্দবুদ্ধি মানুষও নিজেদের পাপক্ষয়ের উদেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন ।
৪৪-৪৫) এর ফলে সেখানে এমনই লোক সমাগম হল যে স্বয়ং দেবতারা পর্যন্ত তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন । গোকর্ণ যখন ব্যাসাসনে উপবিষ্ট হয়ে পাঠ করতে শুরু করলেন তখন প্রেতযোনিপ্রাপ্ত ধুন্ধুকারীও সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং নিজের জন্য স্থান অন্বেষণ করতে লাগল । এরপর উলম্ব অবস্থায় প্রোথিত একটি সাত গাঁঠ যুক্ত বাঁশের উপর তার দৃষ্টি পড়লো ।
৪৬) সেই বাঁশের নিচের একটি ছিদ্রের মাধ্যমে সে বাঁশের ভিতরে প্রবেশ করলো এবং পাঠ শুনতে থাকলো । বায়ুরূপী হওয়ার কারণে সে বাইরে কোথাও বসে স্থিত হয়ে পাঠ শ্রবনে অসমর্থ ছিল । তাই সে বাঁশের মধ্যে প্রবেশ করল ।
৪৭) একজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে গোকর্ণ মুখ্য শ্রোতারূপে নিশ্চিত করলেন এবং প্রথম স্কন্ধ থেকে সুস্পষ্টস্বরে ভাগবত পাঠ আরম্ভ করলেন ।
৪৮) দিনান্তে যখন পাঠের বিশ্রাম দেওয়া হল তখন এক বড়ই বিচিত্র ঘটনা ঘটল । সভাস্থ সকলের সম্মুখেই সেই সাত গাঁট বিশিষ্ট বাঁশটির একটি গাঁট সশব্দে ফেটে গেল ।
৪৯) একই ভাবে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় গাঁটটি ফেটে গেল এবং তৃতীয় দিনে একই সময়ে তৃতীয় গাঁটটিও ফেটে গেল ।
৫০-৫১) এইভাবে সপ্তাহব্যাপী ভাগবতের দ্বাদশ স্কন্ধ শ্রবণের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে এবং ওই বাঁশের সাতটি গাঁট ভেদ করে ধুন্ধুকারী প্রেতযোনি থেকে পরিত্রান পেল । তারপর সে দিব্যরূপ ধারণ করে সকলের সামনে দেখা দিল । তার মনোমোহক ঘনশ্যাম তনু পীতাম্বর আর তুলসী মালায় সুশোভিত , মস্তকে অপরূপ মুকুট এবং কর্ণদ্বয়ে সুন্দর কুন্ডল শোভা পাচ্ছিল ।
৫২) নিজ ভ্রাতা গোকর্ণকে সে সত্বর প্রণাম করল এবং বলল - ' হে ভ্রাতা ! তুমি কৃপা করে আমাকে এই ভয়াবহ প্রেতযোনি থেকে মুক্তি দিয়েছ ।
৫৩) প্রেতপীড়া বিনাশকারী এই শ্রীমদ্ভাগবত কথা ধন্য । আর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমধাম প্রদানকারী শ্রীমদ্ভাগবতের এই সপ্তাহ পারায়ণও ধন্য ।
৫৪) যখন এই সপ্তাহব্যাপী শ্রীমদ্ভাগবতের শ্রবণের অনুষ্ঠান হয় তখন সকল পাপরাশি ভয়ে কাঁপতে শুরু করে কারণ তারা অবগত হয় যে এই ভাগবতীকথা তাদের প্রলয়ের কারণ হবে ।
৫৫) অগ্নি যেমন আর্দ্র - শুষ্ক , ছোট - বড় সকল কাষ্ঠকেই ভস্মীভূত করে , তেমনই এই শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণের ফলে বাক্য , মন ও কর্মকৃত ছোট - বড় , নুতন - পুরাতন সকল প্রকারের পাপই ভস্মীভূত হয়ে যায় ।
৫৬) পন্ডিতগণ দেবতাদের সভায় বলেছিলেন , যে ব্যক্তি ভারতবর্ষে শ্রীমদ্ভাগবত কথা না শ্রবণ করে তার জন্মই বৃথা ।
৫৭) এটা সত্যিই যে , মোহপাশে আবদ্ধ হয়ে এই অনিত্য শরীর কে হৃষ্টপুষ্ট আর বলবান করে যদি এই শুকশাস্ত্র ( শ্রীমদ্ভাগবত ) না শ্রবণ হয় তাহলে সেই শরীরেরই বা কি প্রয়োজন ?
৫৮) অনিত্য এই শরীরের স্তম্ভ ( কাঠামো ) হল অস্থি , স্নায়ুরূপ দড়ি দিয়ে এটি বাঁধা , মাংস আর শোনিত ( রুধির বা রক্ত ) দ্বারা এটা লেপিত , আর উপরে চর্মদ্বারা আবৃত । এর প্রতিটি অঙ্গই দুর্গন্ধযুক্ত কারণ প্রকৃতপক্ষে এটা মূত্র এবং পুরীষের ( মল বা বিষ্ঠা ) একটি পাত্র বৈ কিছু নয় ।
৫৯) এই শরীর জরাবস্থা ( বৃদ্ধাবস্থা ) এবং নানাবিধ শোক দুঃখের জন্য কেবলই দুঃখপরিণামী । এই শরীর সর্বদাই অতৃপ্ত থাকে কারণ নিরন্তর কোনো না কোনো কামনায় এটি দগ্ধ হতেই থাকে । এই শরীর বিভিন্ন রোগের আঁতুড়ঘর এবং একে ধারণ করে থাকাটাও ভারস্বরূপ । এ নানাদোষে পরিপূর্ণ এবং ক্ষণভঙ্গুর ( মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ) ।
৬০) মরণোত্তর সমাধি দিলে এই শরীর কৃমিতে পরিণত হয় , কোনো জীবের ভোজন হলে এ বিষ্ঠায় পরিণত হয় আর অগ্নিতে দগ্ধ হলে ভষ্মে ( ছাই ) পরিণত হয় । শরীরের এই তিন পরিণতিই গণ্য করা হয় । তাহলে এইরূপ নশ্বর শরীর দিয়ে মানব অবিনশ্বর ফলপ্রদায়ী কর্ম কেন করে না ?
৬১) প্রাতঃকালে যে অন্ন পরিপাক করা হয় তা সায়ংকালেই বিনষ্ট হয় । সেই অন্নরসে পুষ্ট এই শরীর কি করে নিত্য হবে ?
৬২) এই ধরাতলে শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণের ফলে মানুষের ভগবৎপ্রাপ্তি নিকটতর হয় । সুতরাং সকল প্রকার দোষ নিবৃত্তির জন্য এই সাধন শ্রেয় ।
৬৩) যে সকল ব্যক্তির জীবন এই শ্রীমদ্ভাগবতকথা বর্জিত , তাদের অবস্থা জলের উপর বুদবুদের ন্যায় অথবা জীবেদের মধ্যে মশকের ( মশা ) ন্যায় - যেটা কেবল মরণের জন্য জন্মায় ।
৬৪) যার অমোঘ প্রভাবে জড় ও শুষ্ক বাঁশের গাঁট ফাটতে পারে সেই শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণে অন্তঃকরণের গ্রন্থিভেদই বা কি বড় কথা ?
৬৫) শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণে মানুষের হৃদয়গ্রন্থির ছেদন হয়ে যায় । মনের সর্বপ্রকার সংশয় দূরীভূত হয় এবং সমস্ত কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায় ।
৬৬) এই শ্রীমদ্ভাগবত কথাতীর্থ সংসারের কাদা ও ক্লেশ প্রক্ষালন ( ধুয়ে দিতে ) করতে অতীব পটীয়সী । বুদ্ধিমানগণ বলেন , এই কথা চিত্তে স্থিত হলে সেই মানবের মুক্তি অবশ্যম্ভাবি ।'
৬৭) ধুন্ধুকারী যখন এইসব কথা বলছিল তখন বৈকুন্ঠবাসী পার্ষদগণ সংযুক্ত এক বিমান সেখানে এসে উপস্থিত হল । সেই দিব্য বিমান থেকে সর্বত্র মণ্ডলাকার দীপ্তি প্রস্ফুরিত হচ্ছিল ।
৬৮) সকলেই দেখলেন যে ধুন্ধুলীসুত ( ধুন্ধুকারী ) সেই বিমানে উঠে বসল । সেই বিমানে উপবিষ্ট পার্ষদদের দেখে গোকর্ণ এই কথা বললেন ।
৬৯-৭০) গোকর্ণ প্রশ্ন করলেন - হে ভগবানের প্রিয় পার্ষদবৃন্দ ! এখানে তো অনেক নির্মল এবং শুদ্ধ অন্তঃকরণযুক্ত শ্রোতারা আছেন , এদের সকলের জন্য আপনারা বিমান আনেননি কেন ? আমার দৃষ্টিতে এরা সকলেই সমানভাবে পাঠ শ্রবণ করেছে , কিন্তু এদের মধ্যে ফলভেদ কেন জন্মাল, সেকথা আমাকে দয়া করে বলুন ।
৭১) শ্রীভগবানের পার্ষদগণ বললেন - হে মান্যবর ! এদের এই ফলভেদের কারণ হল এদের শ্রবণের পাৰ্থক্য । একথা যদিও সত্য যে পাঠ শ্রবণ সবাই সমানভাবে করেছে কিন্তু ধুন্ধুকারীর মতন কেউই মনোযোগ সহকারে এবং স্থিরচিত্তে শ্রবণ করেনি । সেজন্যই সবাই একসাথে শ্রবণ করলেও এদের শ্রবণের ফলপার্থক্য এসেছে ।
৭২) এই প্রেত সাতদিন যাবৎ উপোষ করে শ্রীমদ্ভাগবত কথা শ্রবণ করেছে এবং শ্ৰুত বিষয়বস্তুগুলি স্থিরচিত্তে উত্তমরূপে মনন ও পুরঃশ্চরন করেছে ।
৭৩) অদৃঢ় জ্ঞান ব্যর্থ হয়ে যায় । তেমনি অমনোযোগী অবস্থায় শ্রবণ , সন্দেহ থাকলে মন্ত্রের , ব্যগ্রচিত্ত বা চিত্তচঞ্চল অবস্থায় জপেরও কোনো ফল হয় না ।
৭৪) বৈষ্ণবহীন দেশ , অপাত্র-কৃত শ্রাদ্ধান্নভোজন , অশ্রোত্রয়ীকে দেওয়া দান এবং আচারহীন কুল - এই সবই বিনষ্ট হয় ।
৭৫-৭৬) গুরুবাক্যে নিশ্চিত বিশ্বাস , নিজ দীনভাব , মনের সমস্ত দোষের উপর জয়লাভ এবং একাগ্র চিত্তে পাঠ শ্রবণ - এইসব নিয়ম যদি পালন করে পাঠ শ্রবণ করা হয় তাহলে শ্রবণের যথার্থ ফললাভ হয় । যদি এই সব শ্রোতারা সকল নিয়মপালনপূর্বক পুনরায় শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ শ্রবণ করেন তাহলে নিশ্চিতরূপেই এরা বৈকুণ্ঠবাসি হবেন ।
৭৭) হে গোকর্ণ ! পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি স্বয়ং এসে আপনাকে গোলোকধামে নিয়ে যাবেন । পার্ষদগণ এই কথা বলে হরি কীর্তন করতে করতে বৈকুণ্ঠধামের উদ্দেশ্যে প্ৰস্থান করলেন ।
৭৮) শ্রাবণ মাসে গোকর্ণ পুনরায় শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী পারায়ণ করলেন এবং ঐসকল শ্রোতারা পুনরায় স্থিরচিত্ত হয়ে পাঠ শ্রবণ করলেন ।
৭৯) হে দেবর্ষি নারদ এই সপ্তাহব্যাপী পাঠের শেষে কি হয়েছিল সে সম্পর্কে অবগত হউন ।
৮০) ভক্তবৃন্দ পরিপূর্ণ বিমানে স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন । চারিদিক থেকে খুব জয়-জয়কার এবং নমস্কারসূচক ধ্বনি মুখরিত হতে থাকল ।
৮১) স্বয়ং ভগবান সহর্ষে পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন এবং আলিঙ্গনপূর্বক তিনি গোকর্ণকে নিজের সদৃশ করে দিলেন ।
৮২) ক্ষণকালের মধ্যেই তিনি অন্যান্য সকল শ্রোতাদেরও ঘনশ্যাম পীতাম্বরধারী এবং কিরীট ও কুণ্ডলাদি শোভিত করে দিলেন ।
৮৩-৮৪) ওই গ্রামে সারমেয় ( কুকুর ) ও চণ্ডাল পর্যন্ত যত জীব ছিল তারাও সকলে গোকর্ণের কৃপায় বিমানে স্থান পেল । যে ভাগবৎধামে যোগীরা গমন করেন তাদেরও সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল । এইভাবে গোপীবল্লভ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ , ভাগবত পাঠ শ্রবনে পরিতুষ্ট হয়ে গোকর্ণকে নিয়ে নিজের পরমধাম গোলোকে চলে গেলেন ।
৮৫) ত্রেতাযুগে যেমন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামভদ্র অযোধ্যাবাসীকে নিজের সাথে নিয়ে সাকেতধামে গমন করেছিলেন , তেমনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তাদের নিয়ে যোগীদুর্লভ গোলোকধামে গেলেন ।
৮৬) যে লোকে সূর্য , চন্দ্র বা সিদ্ধগণেরও গতি হয় না শ্রীমদ্ভাগবতের শ্রোতারা সেই লোকে গমন করলেন ।
৮৭) হে দেবর্ষি নারদ ! এই সপ্তাহযজ্ঞের পাঠশ্রবণে যে কি রকম উজ্বল ফললাভ হয় সে বিষয়ে আপনাকে আর কিই বা ব্যক্ত করব ? অহো ! নিজ কর্ণে যারা গোকর্ণের ওই পাঠের কেবলমাত্র এক অক্ষরও শ্রবণ করেছে , তাদের আর দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করতে হয়নি ।
৮৮) কেবলমাত্র বায়ুপান কিংবা শুধুমাত্র জল এবং গাছের পাতা ভক্ষণের মাধ্যমে শরীরকে শীর্ণ করে , বহুকাল কঠোর তপস্যা করে অথবা কঠিন যোগমার্গ অবলম্বন করেও যে গতি লাভ করা যায় না , শুধুমাত্র শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহশ্রবণের মাধ্যমেই তা সহজলভ্য হয় ।
৮৯) এই পরম পবিত্র এবং পুণ্যময় ইতিহাস চিত্রকূটস্থ মুনীশ্বর শান্ডিল্যও ব্রহ্মানন্দে স্থিত হয়ে পরমানন্দে পাঠ করতে থাকেন ।
৯০) এই আখ্যান অতি পবিত্র । এর কেবলমাত্র একবার শ্রবণেই সমস্ত পাপরাশি ভস্মীভূত হয়ে যায় । শ্রাদ্ধকালে এর পাঠ হলে পিতৃগণ তৃপ্ত হন এবং নিত্য পাঠ করলে মোক্ষপ্রাপ্তি হয় ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই, আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগলো তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ |
|| ওম নমঃ ভগবতে বাসুদেবায় ||
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায়
ধুন্ধুকারীর প্রেতযোনি প্রাপ্তি এবং তা থেকে মুক্তি
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের চতুর্থ অধ্যায়, গোকর্ণ উপাখ্যান সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের পঞ্চম অধ্যায়, ধুন্ধুকারীর প্রেতযোনি প্রাপ্তি এবং তা থেকে মুক্তি সম্পর্কে জানবো । এটি শুরু হয় সুত দ্বারা বর্ণিত দেবর্ষি নারদের সাথে সনকাদি মুনিগণের কথোপকথন এর মাধ্যমে ।
১) সুত বললেন - হে মুনিবর শৌনক ! ধুন্ধুকারীর পিতা আত্মদেব যখন অরণ্যবাসী হলেন তখন ধুন্ধুকারী তার জননীকে প্রচন্ড প্রহারপূর্বক বলল - সঞ্চিত অর্থ সকল কোথায় রেখেছ বল , নচেৎ এখনই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব ।
২) ধুন্ধুলী এই ধমকানিতে ভয় পেয়ে এবং ছেলে ধুন্ধুকারীর অত্যাচারে সন্ত্রস্ত হয়ে সেই রাত্রে কূপে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করল ।
৩) যোগারূঢ় গোকর্ণ তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । এই ঘটনাতে তার মনের মধ্যে কোনপ্রকার সুখ বা দুঃখ অনুভূত হল না ; কারণ তাঁর কোনো শত্রু বা মিত্র কিছুই ছিল না ।
৪) পাঁচটি কুলটা মেয়ে ( বেশ্যা ) নিয়ে ধুন্ধুকারী বাড়িতে বসবাস করতে থাকল । সেই কুলটা মেয়েদের জন্য ভোগ্যবস্তু জোগাড়ের চিন্তাতে তার বুদ্ধিভ্রম হল এবং সে নানানরকম অত্যুগ্র ( ক্রুর , খারাপ ) কর্ম করতে লাগল ।
৫) সেই কুলটা মেয়েরা একদিন তার কাছ থেকে অনেক গহনা চেয়ে বসল । ধুন্ধুকারী তো কামনার বশে উন্মত্ত হয়েই ছিল, এমনকি মৃত্যুর চিন্তাও কখনও হত না তার । সেই গহনা জোগাড় করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ।
৬) ধুন্ধুকারী বিভিন্ন জায়গায় চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অনেক অর্থ বাড়ি নিয়ে এলো । তারপর কিছু সুন্দর আভূষণ ( গহনা ) এবং সুন্দর সুন্দর বস্ত্র এনে ওই পাঁচ জন কে দিল ।
৭) চুরি করা প্রচুর ধনসম্পদ দেখে এক রাত্রে সেই পাঁচ বেশ্যারা যুক্তি করলো যে ' এই ধুন্ধুকারী তো প্রত্যহই চুরি করে , ফলে একদিন না একদিন হোক রাজার লোকেরা নিশ্চয়ই একে ধরে নিয়ে যাবে ।
৮) তখন রাজা এই সব ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে একে নিশ্চয়ই প্রাণদন্ড দেবে । সুতরাং একে যখন একদিন সেই মরতেই হবে তাহলে আমরাই একে গোপনে হত্যা করি না কেন এই ধনসম্পত্তির জন্য ।
৯-১০) একে হত্যা করে এর এই সব সম্পদ নিয়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব ।' এই চিন্তা করে তারা ধুন্ধুকারীকে ঘুমন্ত অবস্থায় রশ্মি ( দড়ি ) দিয়ে বেঁধে তার গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করল । এরপরেও যখন ধুন্ধুকারী মরল না , সেটা দেখে তারা চিন্তাতুরা হয়ে পড়ল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
১২) ওই বেশ্যারা ধুন্ধুকারীর দেহটা একটা গর্তের মধ্যে পুরে মাটি চাপা দিয়ে দিল । আসলে অসৎ নারীরা এইরকমই দুঃসাহসী হয় । তাদের এই দুষ্কর্মের সংবাদ কেউই জানল না ।
১৩) লোকেরা তাদের ধুন্ধুকারীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল - আমাদের প্রিয়তম এবার অর্থের সন্ধানে বহু দূরদেশে গিয়েছেন । এক বছরের মধ্যেই তিনি ফিরে আসবেন ।
১৪) বুদ্ধিমান মনুষ্যদের কখনও এইপ্রকার দুষ্টা নারীদের বিশ্বাস করা উচিত নয় । যে সকল মূঢ় ব্যক্তিরা এদের কথা বিশ্বাস করে তাদের অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয় ।
১৫) এদের রসময়ী কথা কামুকদের হৃদয়ে অমৃতরসের সঞ্চার করে কিন্তু এদের হৃদয় শানিত ক্ষুরের ন্যায় তীক্ষ্ণ হয় । সুতরাং এই সকল নারীরা কাদের প্রতিই বা আসক্ত হবে ?
১৬) সেইসকল বেশ্যারা ধুন্ধুকারীর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করল; তাদের এইরূপ স্বামী আরও কত ছিল । এদিকে ধুন্ধুকারী নিজের অতীব কুকর্মের পরিনামবশত ভয়ঙ্করপ্রেতযোনি প্রাপ্ত হল ।
১৭-১৮) সে ভীষণ ঝড়ের রূপ ধরে নিত্যই দশদিক উত্যক্ত করে বেড়াত । শীত-গ্রীষ্মে জর্জরিত হয়ে ও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে নিজের পরিণতির উপর সর্বদাই হা-হুতাশ করত । কিছুকাল পরে গোকর্ণও লোকমুখে ধুন্ধুকারীর মৃত্যুসংবাদ পেলেন ।
১৯) তখন ধুন্ধুকারীকে অনাথ বিবেচনা করে গোকর্ণ গয়াতীর্থে গিয়ে তার শ্রাদ্ধনুষ্ঠান সমাপন করলেন এবং অন্যান্য যে সকল তীর্থে তিনি যেতেন সেই সকল তীর্থেও আবশ্যকীয় শ্রাদ্ধ-ক্রিয়াদি করলেন ।
২০) এইভাবে ভ্রমণ করতে করতে একদিন গোকর্ণ নিজের গৃহে এলেন এবং সবার অলক্ষ্যে বাড়ির আঙিনায় রাত্রিবাস করতে নিশ্চয় করলেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
২২) কখনও ভেড়া , কখনও হস্তী , কখনও মহিষ , কখনও ইন্দ্র , কখনও বা অগ্নির রূপ ধারণ করল । শেষকালে সে আবার মনুষ্যরূপে দেখা দিল ।
২৩) এইসকল বৈপরীত্যপূর্ণ অসাধারণ সব ব্যাপার দেখে গোকর্ণ স্থির করলেন যে এ নিশ্চয়ই কোনও দুর্গতিপ্রাপ্ত । তখন তিনি ধৈর্যপূর্বক তাকে জিজ্ঞেস করলেন ।
২৪) গোকর্ণ জিজ্ঞেস করলেন যে - তুমি কে ? রাত্রিবেলায় আমাকে এইসব ভয়ানক রূপ দেখাচ্ছ কেন ? তুমি এই দশাপ্রাপ্তই বা হলে কিভাবে ? আমাকে ঠিক করে বল - তুমি প্রেত , পিশাচ না রাক্ষস ?
২৫) সুত বললেন - গোকর্ণর এইরকম প্রশ্ন করাতে সে পুনঃ পুনঃ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করতে লাগল । তার কথা বলার সামর্থ ছিল না । তাই সে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল ।
২৬) গোকর্ণ তখন গণ্ডূষে জল নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে সেই মন্ত্রপূত জল তার গায়ে ছিটিয়ে দিলেন । এতে তার কিছু পাপ বিনষ্ট হল , আর তারফলে সে বলতে লাগল ।
২৭) প্রেত বলল - ' আমি তোমার ভ্রাতা । আমার নাম ধুন্ধুকারী । নিজের কৃতকর্মের দোষেই আমি নিজের ব্রাহ্মণত্বের নাশ করেছি ।
২৮) আমার কুকর্মের কোনো সীমা পরিসীমা নেই । আমি ভীষণ অজ্ঞানান্ধকারে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম । আমি অনেক হিংসাবৃত্তি করেছি এবং তা অনেক মানুষের হানি করেছে । অবশেষে স্ত্রীবেশী ওই কুলটা নারীগুলো আমাকে হত্যা করেছে ।
২৯) এর ফলস্বরূপ আমি প্রেতযোনিতে পতিত হয়ে এই দুর্দশা ভোগ করছি । বর্তমানে দৈববশে কর্মফলের উদয় হওয়ার জন্য আমি কেবল বায়ুপান করে জীবনধারণ করছি ।
৩০) ভ্রাতা গোকর্ণ ! তুমি তো কৃপাসিন্ধু , আমার অশ্রুমোচন করে তুমি শীঘ্রই আমাকে এই প্রেতযোনি থেকে মুক্ত করো । ' গোকর্ণ ধুন্ধুকারীর সব কথা শুনলেন এবং এই কথা বললেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৩২) গয়াশ্রাদ্ধতেও যদি তোমার মুক্তি না হয়ে থাকে তাহলে তো আমি আর কোনো উপায়ই দেখছি না । তুমি আমাকে সব কথা বিস্তারপূর্বক বল - এখন আমার কি করা বিধেয় (কর্তব্য) ?
৩৩) প্রেত বলল - শত গয়াশ্রাদ্ধতেও আমার মুক্তিলাভ হবে না । তুমি আমার মুক্তিলাভের অন্য কোনো উপায়ের বিচার করো ।
৩৪) প্রেতের এই কথা শুনে গোকর্ণ বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হলেন । তিনি বললেন ' শত গয়াশ্রাদ্ধতেও যদি তোমার এই প্রেতযোনি থেকে মুক্তি না হয় তবে তো তোমার উদ্ধারের পথ অসম্ভব বলে প্রতিত হচ্ছে ।
৩৫) আচ্ছা তুমি এখন নির্ভয়ে স্বস্থানে থাক , আমি বিচার বিবেচনা করে তোমার উদ্ধারের কোনো উপায় করবো ।'
৩৬) গোকর্ণের নির্দেশমতো ধুন্ধুকারী সেই স্থান থেকে নিজের জায়গায় চলে গেল । এদিকে গোকর্ণ সমস্ত রাত্রি এই ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করলেন কিন্তু কোনো উপায়ই তিনি খুঁজে পেলেন না ।
৩৭) প্রাতঃকালে ওইস্থলে গোকর্ণকে দেখে সকলেই খুশি হয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন । গোকর্ণ তখন সেখানে সমবেত সকলকেই পূর্বরাত্রের ঘটনা সম্পর্কে অবগত করালেন ।
৩৮) তাদের মধ্যে যারা বিদ্বান, যোগনিষ্ঠ , জ্ঞানী ও বেদজ্ঞ ছিলেন তারাও সকলেই অনেক শাস্ত্রবিচার করলেন , তথাপি ধুন্ধুকারীর মুক্তির উপায়ের কোনো পথ পাওয়া গেল না ।
৩৯) এমতাবস্থায় সেখানে উপস্থিত সকলেই এই সিদ্ধান্ত করলেন যে , এই বিষয়ে সূর্যদেব যা বিধান দেবেন তাই কর্তব্য । গোকর্ণ তখন আপন তপোবলের প্রভাবে সূর্যবেদবের গতি স্তব্ধ করে দিলেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৪২) তখন সকলেই বললেন ' নিষ্ঠাপূর্বক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করো , আর এর অনুষ্ঠানও অতি সরল । ' তখন গোকর্ণও সেই অনুযায়ী মনস্থির করে শ্রীমদ্ভাগবত সপ্তাহ পারায়ণের প্রস্তুতি নিলেন ।
৪৩) সেই ভাগবত কথা শ্রবণের জন্য নানাদেশ , গ্রামগঞ্জ থেকে অনেকে উপস্থিত হলেন । অনেক পঙ্গু , অন্ধ , বৃদ্ধ , মন্দবুদ্ধি মানুষও নিজেদের পাপক্ষয়ের উদেশ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন ।
৪৪-৪৫) এর ফলে সেখানে এমনই লোক সমাগম হল যে স্বয়ং দেবতারা পর্যন্ত তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন । গোকর্ণ যখন ব্যাসাসনে উপবিষ্ট হয়ে পাঠ করতে শুরু করলেন তখন প্রেতযোনিপ্রাপ্ত ধুন্ধুকারীও সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং নিজের জন্য স্থান অন্বেষণ করতে লাগল । এরপর উলম্ব অবস্থায় প্রোথিত একটি সাত গাঁঠ যুক্ত বাঁশের উপর তার দৃষ্টি পড়লো ।
৪৬) সেই বাঁশের নিচের একটি ছিদ্রের মাধ্যমে সে বাঁশের ভিতরে প্রবেশ করলো এবং পাঠ শুনতে থাকলো । বায়ুরূপী হওয়ার কারণে সে বাইরে কোথাও বসে স্থিত হয়ে পাঠ শ্রবনে অসমর্থ ছিল । তাই সে বাঁশের মধ্যে প্রবেশ করল ।
৪৭) একজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে গোকর্ণ মুখ্য শ্রোতারূপে নিশ্চিত করলেন এবং প্রথম স্কন্ধ থেকে সুস্পষ্টস্বরে ভাগবত পাঠ আরম্ভ করলেন ।
৪৮) দিনান্তে যখন পাঠের বিশ্রাম দেওয়া হল তখন এক বড়ই বিচিত্র ঘটনা ঘটল । সভাস্থ সকলের সম্মুখেই সেই সাত গাঁট বিশিষ্ট বাঁশটির একটি গাঁট সশব্দে ফেটে গেল ।
৪৯) একই ভাবে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় গাঁটটি ফেটে গেল এবং তৃতীয় দিনে একই সময়ে তৃতীয় গাঁটটিও ফেটে গেল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৫২) নিজ ভ্রাতা গোকর্ণকে সে সত্বর প্রণাম করল এবং বলল - ' হে ভ্রাতা ! তুমি কৃপা করে আমাকে এই ভয়াবহ প্রেতযোনি থেকে মুক্তি দিয়েছ ।
৫৩) প্রেতপীড়া বিনাশকারী এই শ্রীমদ্ভাগবত কথা ধন্য । আর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরমধাম প্রদানকারী শ্রীমদ্ভাগবতের এই সপ্তাহ পারায়ণও ধন্য ।
৫৪) যখন এই সপ্তাহব্যাপী শ্রীমদ্ভাগবতের শ্রবণের অনুষ্ঠান হয় তখন সকল পাপরাশি ভয়ে কাঁপতে শুরু করে কারণ তারা অবগত হয় যে এই ভাগবতীকথা তাদের প্রলয়ের কারণ হবে ।
৫৫) অগ্নি যেমন আর্দ্র - শুষ্ক , ছোট - বড় সকল কাষ্ঠকেই ভস্মীভূত করে , তেমনই এই শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণের ফলে বাক্য , মন ও কর্মকৃত ছোট - বড় , নুতন - পুরাতন সকল প্রকারের পাপই ভস্মীভূত হয়ে যায় ।
৫৬) পন্ডিতগণ দেবতাদের সভায় বলেছিলেন , যে ব্যক্তি ভারতবর্ষে শ্রীমদ্ভাগবত কথা না শ্রবণ করে তার জন্মই বৃথা ।
৫৭) এটা সত্যিই যে , মোহপাশে আবদ্ধ হয়ে এই অনিত্য শরীর কে হৃষ্টপুষ্ট আর বলবান করে যদি এই শুকশাস্ত্র ( শ্রীমদ্ভাগবত ) না শ্রবণ হয় তাহলে সেই শরীরেরই বা কি প্রয়োজন ?
৫৮) অনিত্য এই শরীরের স্তম্ভ ( কাঠামো ) হল অস্থি , স্নায়ুরূপ দড়ি দিয়ে এটি বাঁধা , মাংস আর শোনিত ( রুধির বা রক্ত ) দ্বারা এটা লেপিত , আর উপরে চর্মদ্বারা আবৃত । এর প্রতিটি অঙ্গই দুর্গন্ধযুক্ত কারণ প্রকৃতপক্ষে এটা মূত্র এবং পুরীষের ( মল বা বিষ্ঠা ) একটি পাত্র বৈ কিছু নয় ।
৫৯) এই শরীর জরাবস্থা ( বৃদ্ধাবস্থা ) এবং নানাবিধ শোক দুঃখের জন্য কেবলই দুঃখপরিণামী । এই শরীর সর্বদাই অতৃপ্ত থাকে কারণ নিরন্তর কোনো না কোনো কামনায় এটি দগ্ধ হতেই থাকে । এই শরীর বিভিন্ন রোগের আঁতুড়ঘর এবং একে ধারণ করে থাকাটাও ভারস্বরূপ । এ নানাদোষে পরিপূর্ণ এবং ক্ষণভঙ্গুর ( মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ) ।
৬০) মরণোত্তর সমাধি দিলে এই শরীর কৃমিতে পরিণত হয় , কোনো জীবের ভোজন হলে এ বিষ্ঠায় পরিণত হয় আর অগ্নিতে দগ্ধ হলে ভষ্মে ( ছাই ) পরিণত হয় । শরীরের এই তিন পরিণতিই গণ্য করা হয় । তাহলে এইরূপ নশ্বর শরীর দিয়ে মানব অবিনশ্বর ফলপ্রদায়ী কর্ম কেন করে না ?
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৬২) এই ধরাতলে শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণের ফলে মানুষের ভগবৎপ্রাপ্তি নিকটতর হয় । সুতরাং সকল প্রকার দোষ নিবৃত্তির জন্য এই সাধন শ্রেয় ।
৬৩) যে সকল ব্যক্তির জীবন এই শ্রীমদ্ভাগবতকথা বর্জিত , তাদের অবস্থা জলের উপর বুদবুদের ন্যায় অথবা জীবেদের মধ্যে মশকের ( মশা ) ন্যায় - যেটা কেবল মরণের জন্য জন্মায় ।
৬৪) যার অমোঘ প্রভাবে জড় ও শুষ্ক বাঁশের গাঁট ফাটতে পারে সেই শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণে অন্তঃকরণের গ্রন্থিভেদই বা কি বড় কথা ?
৬৫) শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী শ্রবণে মানুষের হৃদয়গ্রন্থির ছেদন হয়ে যায় । মনের সর্বপ্রকার সংশয় দূরীভূত হয় এবং সমস্ত কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায় ।
৬৬) এই শ্রীমদ্ভাগবত কথাতীর্থ সংসারের কাদা ও ক্লেশ প্রক্ষালন ( ধুয়ে দিতে ) করতে অতীব পটীয়সী । বুদ্ধিমানগণ বলেন , এই কথা চিত্তে স্থিত হলে সেই মানবের মুক্তি অবশ্যম্ভাবি ।'
৬৭) ধুন্ধুকারী যখন এইসব কথা বলছিল তখন বৈকুন্ঠবাসী পার্ষদগণ সংযুক্ত এক বিমান সেখানে এসে উপস্থিত হল । সেই দিব্য বিমান থেকে সর্বত্র মণ্ডলাকার দীপ্তি প্রস্ফুরিত হচ্ছিল ।
৬৮) সকলেই দেখলেন যে ধুন্ধুলীসুত ( ধুন্ধুকারী ) সেই বিমানে উঠে বসল । সেই বিমানে উপবিষ্ট পার্ষদদের দেখে গোকর্ণ এই কথা বললেন ।
৬৯-৭০) গোকর্ণ প্রশ্ন করলেন - হে ভগবানের প্রিয় পার্ষদবৃন্দ ! এখানে তো অনেক নির্মল এবং শুদ্ধ অন্তঃকরণযুক্ত শ্রোতারা আছেন , এদের সকলের জন্য আপনারা বিমান আনেননি কেন ? আমার দৃষ্টিতে এরা সকলেই সমানভাবে পাঠ শ্রবণ করেছে , কিন্তু এদের মধ্যে ফলভেদ কেন জন্মাল, সেকথা আমাকে দয়া করে বলুন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৭১) শ্রীভগবানের পার্ষদগণ বললেন - হে মান্যবর ! এদের এই ফলভেদের কারণ হল এদের শ্রবণের পাৰ্থক্য । একথা যদিও সত্য যে পাঠ শ্রবণ সবাই সমানভাবে করেছে কিন্তু ধুন্ধুকারীর মতন কেউই মনোযোগ সহকারে এবং স্থিরচিত্তে শ্রবণ করেনি । সেজন্যই সবাই একসাথে শ্রবণ করলেও এদের শ্রবণের ফলপার্থক্য এসেছে ।
৭২) এই প্রেত সাতদিন যাবৎ উপোষ করে শ্রীমদ্ভাগবত কথা শ্রবণ করেছে এবং শ্ৰুত বিষয়বস্তুগুলি স্থিরচিত্তে উত্তমরূপে মনন ও পুরঃশ্চরন করেছে ।
৭৩) অদৃঢ় জ্ঞান ব্যর্থ হয়ে যায় । তেমনি অমনোযোগী অবস্থায় শ্রবণ , সন্দেহ থাকলে মন্ত্রের , ব্যগ্রচিত্ত বা চিত্তচঞ্চল অবস্থায় জপেরও কোনো ফল হয় না ।
৭৪) বৈষ্ণবহীন দেশ , অপাত্র-কৃত শ্রাদ্ধান্নভোজন , অশ্রোত্রয়ীকে দেওয়া দান এবং আচারহীন কুল - এই সবই বিনষ্ট হয় ।
৭৫-৭৬) গুরুবাক্যে নিশ্চিত বিশ্বাস , নিজ দীনভাব , মনের সমস্ত দোষের উপর জয়লাভ এবং একাগ্র চিত্তে পাঠ শ্রবণ - এইসব নিয়ম যদি পালন করে পাঠ শ্রবণ করা হয় তাহলে শ্রবণের যথার্থ ফললাভ হয় । যদি এই সব শ্রোতারা সকল নিয়মপালনপূর্বক পুনরায় শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ শ্রবণ করেন তাহলে নিশ্চিতরূপেই এরা বৈকুণ্ঠবাসি হবেন ।
৭৭) হে গোকর্ণ ! পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি স্বয়ং এসে আপনাকে গোলোকধামে নিয়ে যাবেন । পার্ষদগণ এই কথা বলে হরি কীর্তন করতে করতে বৈকুণ্ঠধামের উদ্দেশ্যে প্ৰস্থান করলেন ।
৭৮) শ্রাবণ মাসে গোকর্ণ পুনরায় শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহব্যাপী পারায়ণ করলেন এবং ঐসকল শ্রোতারা পুনরায় স্থিরচিত্ত হয়ে পাঠ শ্রবণ করলেন ।
৭৯) হে দেবর্ষি নারদ এই সপ্তাহব্যাপী পাঠের শেষে কি হয়েছিল সে সম্পর্কে অবগত হউন ।
৮০) ভক্তবৃন্দ পরিপূর্ণ বিমানে স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন । চারিদিক থেকে খুব জয়-জয়কার এবং নমস্কারসূচক ধ্বনি মুখরিত হতে থাকল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৮২) ক্ষণকালের মধ্যেই তিনি অন্যান্য সকল শ্রোতাদেরও ঘনশ্যাম পীতাম্বরধারী এবং কিরীট ও কুণ্ডলাদি শোভিত করে দিলেন ।
৮৩-৮৪) ওই গ্রামে সারমেয় ( কুকুর ) ও চণ্ডাল পর্যন্ত যত জীব ছিল তারাও সকলে গোকর্ণের কৃপায় বিমানে স্থান পেল । যে ভাগবৎধামে যোগীরা গমন করেন তাদেরও সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল । এইভাবে গোপীবল্লভ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ , ভাগবত পাঠ শ্রবনে পরিতুষ্ট হয়ে গোকর্ণকে নিয়ে নিজের পরমধাম গোলোকে চলে গেলেন ।
৮৫) ত্রেতাযুগে যেমন মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামভদ্র অযোধ্যাবাসীকে নিজের সাথে নিয়ে সাকেতধামে গমন করেছিলেন , তেমনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তাদের নিয়ে যোগীদুর্লভ গোলোকধামে গেলেন ।
৮৬) যে লোকে সূর্য , চন্দ্র বা সিদ্ধগণেরও গতি হয় না শ্রীমদ্ভাগবতের শ্রোতারা সেই লোকে গমন করলেন ।
৮৭) হে দেবর্ষি নারদ ! এই সপ্তাহযজ্ঞের পাঠশ্রবণে যে কি রকম উজ্বল ফললাভ হয় সে বিষয়ে আপনাকে আর কিই বা ব্যক্ত করব ? অহো ! নিজ কর্ণে যারা গোকর্ণের ওই পাঠের কেবলমাত্র এক অক্ষরও শ্রবণ করেছে , তাদের আর দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করতে হয়নি ।
৮৮) কেবলমাত্র বায়ুপান কিংবা শুধুমাত্র জল এবং গাছের পাতা ভক্ষণের মাধ্যমে শরীরকে শীর্ণ করে , বহুকাল কঠোর তপস্যা করে অথবা কঠিন যোগমার্গ অবলম্বন করেও যে গতি লাভ করা যায় না , শুধুমাত্র শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তাহশ্রবণের মাধ্যমেই তা সহজলভ্য হয় ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্- পঞ্চম অধ্যায় |
৯০) এই আখ্যান অতি পবিত্র । এর কেবলমাত্র একবার শ্রবণেই সমস্ত পাপরাশি ভস্মীভূত হয়ে যায় । শ্রাদ্ধকালে এর পাঠ হলে পিতৃগণ তৃপ্ত হন এবং নিত্য পাঠ করলে মোক্ষপ্রাপ্তি হয় ।
। ইতি শ্রীপদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যে গোকর্ণমোক্ষবর্ণনং নাম পঞ্চমোহধ্যায়ঃ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই, আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ||
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগলো তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
খুব সুন্দর লিখেছেন দাদা।
ReplyDeleteপরের অধ্যায় গুলো দেবেন দয়া করে
ReplyDelete