<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ |
| ওম নমঃ ভগবতে বাসুদেবায় ||
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুর্থ অধ্যায়
গোকর্ণ উপাখ্যান
প্রিয় ভক্তবৃন্দ এবং সুধীগণ,
পূর্ববর্তী লেখনীতে আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের তৃতীয় অধ্যায়, ভক্তির কষ্টের উপশম সম্পর্কে জেনেছিলাম । আজ আমরা শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যের চতুর্থ অধ্যায়, গোকর্ণ উপাখ্যান সম্পর্কে জানবো । এটি শুরু হয় সুত দ্বারা বর্ণিত দেবর্ষি নারদের সাথে সনকাদি মুনিগণের কথোপকথনের মাধ্যমে।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
২) তাঁর গলা ছিল বনমালায় শোভিত, সারা শ্রীঅঙ্গ সজল জলধরের ন্যায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, পরনে অতি মনমোহক পীতাম্বর , কটিদেশ ছিল কাঞ্চীদামে সুসজ্জিত, মস্তকে মুকুট এবং কর্ণে কুণ্ডলদ্বয় ঝলমল করছিল ।
৩) তিনি ত্রিভঙ্গললিত রূপে দন্ডায়মান হয়ে আপন ভক্তদের মনোহরণ করছিলেন । তাঁর বক্ষে শোভা পাচ্ছিল কৌস্তভ মনি এবং সারা অঙ্গই ছিল হরিচন্দনচৰ্চিত । সেই অপরূপ রূপের শোভা ছিল অবর্ণনীয় । অনুভব হচ্ছিল যেন কোটি মন্মথ / মদনদেব / কামদেবের রূপমাধুর্য একসাথে ঝরে পড়ছে ।
৪) পরমানন্দ স্বরূপ চিন্ময়মূর্তি মধুময় মুরলীধর শ্রীভগবান তখন এক অপূর্ব ভুবনমোহিনী রূপে মূর্ত হয়ে আপন ভক্তদের নির্মল হৃদয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন ।
৫) শ্রীভগবানের নিত্যলোক বৈকুন্ঠনিবাসী লীলা-সহচর উদ্ধবাদি সেখানে অদৃশ্যরূপে উপস্থিত ছিলেন সেই ভাগবতকথামৃত আস্বাদন করবার জন্য ।
৬) প্রভু সেখানে আবির্ভূত হওয়া মাত্রই চারিদিক থেকে ' জয় হোক ! জয় হোক !! ' ইত্যাদি জয়ধ্বনি উত্থিত হতে লাগল । ভক্তিরসের এক অদ্ভুত প্রবাহ চারিদিকে প্রবাহিত হতে লাগল । বারংবার আবীর, পুষ্পবৃষ্টি আর শঙ্খধ্বনি হচ্ছিল ।
৭-৮) সেই সভায় যারা যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সকলেই নিজ দেহ, গৃহ এবং আপন স্বত্বা সম্পর্কে সংজ্ঞাহীন ছিলেন । তাদের এই অদ্ভুত তন্ময়তা লক্ষ করে দেবর্ষি নারদ বললেন - হে মুনিশ্বরগণ ! আমি আজ এই সপ্তাহ শ্রবণের অতি অলৌকিক মহিমা দর্শন করলাম । এখানে যে সকল দুষ্ট , অতি মূর্খ আর পশুপক্ষী রয়েছে তারা সকলেই একেবারে নিষ্পাপ হয়ে গেল।
৯) অতএব এতে আর বিন্দুমাত্রও কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকল না যে এই ঘোর কলিযুগে চিত্তশুদ্ধির জন্য , পাপরাশি নষ্ট করবার জন্য এই শ্রীমদ্ভাগবত কথার মতন পবিত্রতম আর কিছু এই মর্ত্যলোকে নেই ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
১১) সনকাদি কুমারগণ বললেন - যে সকল মানব সর্বদাই নানাপ্রকার পাপকর্ম করে , নিতান্তই দুরাচারী , অসৎপথগামী , ক্রোধবহ্নিতে দগ্ধ , অত্যন্ত কুটিল এবং কামপরায়ন , এরা সকলেই সপ্তাহ যজ্ঞদ্বারা পবিত্র হয়ে যায় ।
১২) যারা মিথ্যাশ্রয়ী , সত্য থেকে চ্যুত , আপন পিতা-মাতার নিন্দুক, বিভিন্নপ্রকার বিষয়বাসনায় জর্জরিত, চতুরাশ্রম ধর্মরহিত ,অহংকারী , মাৎসর্যপরায়ণ , দ্বেষী এবং অপরকে পীড়া - প্রদানকারী , তারাও কলিযুগে এই সপ্তাহযজ্ঞ দ্বারা পবিত্র হয়ে যায় ।
১৩) যারা সুরাপান , ব্রহ্মহত্যা , সুবর্ণতস্করী , গুরুপত্নীগমন ও বিশ্বাসঘাতকতা - এই পঞ্চমহাপাতকের আচরণকারী , ছলচাতুর্যপরায়ণ, ক্রুর ,নির্দয় , ব্রাহ্মনের ধনে পুষ্ট ও ব্যভিচারী , এরাও কলিযুগে সপ্তাহযজ্ঞ দ্বারা পবিত্র হয়ে যায় ।
১৪) যে দুষ্ট ব্যক্তি দুরাগ্রহবশত কায়মনোবাক্যে সর্বদাই কেবব পাপই করে যাচ্ছে , যে অপরের ধনে পুষ্ট , চিত্ত যার কলুষিত ও হৃদয় কুভাবনাযুক্ত তারা সকলেই এই কলিযুগে সপ্তাহশ্রবণের দ্বারা পবিত্র হয়ে যায় ।
১৫) হে দেবর্ষি নারদ ! এই বিষয়ে আমি তোমাকে এক প্রাচীন ইতিহাস শোনাচ্ছি । সে কাহিনী শুনলেও সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে যায় ।
১৬) পুরাকালে তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে এক অপূর্ব সুন্দর নগরী ছিল । সেখানে বসবাসকারী সকল মানুষই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সত্যাশ্রয়ী এবং সৎকর্মপরায়ণ ছিল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
১৮) ধনবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভিক্ষান্নে দিনাতিপাত করতেন । ওই ব্রাহ্মণের ধুন্ধুলী নামে এক কুলীন এবং সুন্দরী ধর্মপত্নী ছিলেন। ধুন্ধুলী ছিলেন খুবই জেদী স্বভাবের ।
১৯) তিনি পরনিন্দা , পরচর্চায় খুবই আনন্দিত হতেন । স্বভাবে তিনি ছিলেন অতি ক্রুর ও বাচাল প্রকৃতির । সর্বদা কিছু না কিছু বকবক করেই চলতেন । ধুন্ধুলী ছিলেন গৃহকর্মে নিপুণা ,কৃপণ এবং ঝগড়াটে ।
২০) এইভাবে ওই ব্রাহ্মণদম্পতি বেশ সুখে স্বাছন্দের মধ্যেই আপন গৃহস্থজীবন যাপন করতেন । অর্থ এবং ভোগসামগ্রীর কোনো অভাব ছিল না তাদের । তাদের ঘরবাড়িও সুন্দর ছিল তথাপি তাদের মনে কিন্তু শান্তি ছিল না ।
২১) এইভাবে দিনাতিপাত হতে থাকল এবং তাদের বয়স যখন অনেকটাই বেড়ে গেল তখন তারা সন্তানলাভের জন্য তৎপর হলেন এবং তদোপলক্ষ্যে নানাপ্রকার পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান প্রারম্ভ করলেন । অনেক দীনদুঃখীদের ধেনু , ভূমি, সুবর্ণ ও বস্ত্রাদিও দান করতে লাগলেন তারা ।
২২) এইভাবে সন্তানপ্রাপ্তির আশায় অনুষ্ঠানাদি, দান ইত্যাদি ধৰ্ম-কর্ম সম্পাদনের পর যখন তাদের অর্ধেক সম্পত্তি ব্যায় হয়ে গেল কিন্তু কোনো সন্তানাদির প্রাপ্তি হল না , তখন ওই ব্রাহ্মণ খুবই চিন্তাতুর হয়ে পড়লেন ।
২৩) একদিন ওই ব্রাহ্মণ সন্তানচিন্তায় ব্যাকুল হয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হৃদয়ে গৃহত্যাগ করে অরণ্যের উদ্যেশে যাত্রা করলেন । পথ চলতে চলতে দ্বিপ্রহরকালে তৃষ্ণার্ত হয়ে তিনি এক সরোবরের কাছে এসে পৌঁছলেন ।
২৪) সন্তানের শোকে ওই ব্রাহ্মণ বড়ই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন এবং সন্তানভাব জনিত শোকে তার শরীর অত্যন্ত ক্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিল । তাই সরোবরের জলপান করবার পর তিনি সেখানেই ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন । প্রায় এক ঘটিকা পর এক মহাত্মা সন্ন্যাসীও সেখানে জলপান করবার জন্য এলেন ।
২৫) ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীর জল পান করার অপেক্ষা করলেন এবং যখন দেখলেন যে সন্ন্যাসীর জলপান সমাপ্ত হয়েছে তখন তিনি ওই সন্ন্যাসীর কাছে গেলেন এবং তাঁকে যথাযত সম্মান প্রদশনপূর্বক প্রণাম করে তাঁর সমীপে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন ।
২৬) ওই অবস্থায় ব্রাহ্মণ কে দন্ডায়মান দেখে সন্ন্যাসী প্রশ্ন করলেন - হে দ্বিজ ! তোমার কিসের দুশ্চিন্তা ! তুমি রোদনই বা করছো কেন ? তোমার শোকের কারণ শীঘ্রই আমাকে খুলে বল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
২৮) দেবগন ও বিপ্রগণও আমার দ্বারা প্রদত্ত দ্রব্য প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন না । সন্তানভাবে আমি চারিদিকে কেবলই শুন্য দেখছি । তাই আমি প্রাণত্যাগ করবার উদ্দেশ্যে এই অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করেছি ।
২৯) আমার এই নিঃসন্তান জীবনকে ধিক্ , সন্তানহীন গৃহকে ধিক্ , সন্তানহীন ধন-সম্পদ-ঐশ্বর্যে ধিক্ এবং এই নিঃসন্তান বংশকেও ধিক্ ।
৩০) আমার গৃহে যেই গাভীই পালন করা হয় ,সে বন্ধ্যা হয়ে যায় , যে বৃক্ষই রোপন করি তাতেও মুকুল, ফুল, ফল কিছুই আসে না ।
৩১) আমার গৃহে যে ফলমূল আনা হয় তাতেও শীঘ্রই পচন ধরে যায় । তাই আমার মত অভাগা ও নিঃসন্তান মানুষের এই জীবনের কিই বা প্রয়োজন ।
৩২) এই কথা বলে ওই ব্রাহ্মণ দুঃখে ব্যাকুল হয়ে সন্যাসী মহাত্মার কাছে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলেন । এই দেখে ওই সন্ন্যাসীর হৃদয়ে বড়ই করুনার উদ্রেক হল ।
৩৩) ওই সন্ন্যাসী ছিলেন যোগনিষ্ঠ , তাই তিনি ব্রাহ্মণের ললাটরেখা দেখে সবকিছুই জ্ঞাত হলেন এবং ব্রাহ্মণকে সব বিস্তৃতরূপে বলতে লাগলেন ।
৩৪) সন্যাসী ওই ব্রাহ্মণ কে বললেন - হে বিপ্র ! তুমি তোমার এই বিষম পুত্রলাভের মোহ পরিত্যাগ কর । তোমার কৃতকর্মের গতি অতি প্রবল তাই নিজের বিবেকের আশ্রয় নিয়ে সংসারের বাসনা পরিত্যাগ কর ।
৩৫) হে বিপ্রবর ! মন দিয়ে শোনো ! তোমার প্রারব্ধ / ভাগ্য দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে আগামী সাত জন্ম পর্যন্ত কোনো প্রকারেই তোমার কোন সন্তানাদি হবে না ।
৩৬) পুরাকালে বিখ্যাত রাজা সগর এবং অঙ্গকেও সন্তানজনিত দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল । তাই হে ব্রাহ্মণ ! তুমি এই মুহূর্তে তোমার বংশরক্ষার আশা পরিত্যাগ কর ও সন্ন্যাসে যত্নবান হও । সন্ন্যাসেই সকল প্রকার সুখ বিদ্যমান ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
৩৮) যে আশ্রমে স্ত্রী-পুত্র-পৌত্রাদির সুখ নেই , সেই সন্ন্যাস তো সর্বতভাবেই নিরস । এই লোকে পুত্র-পৌত্রাদিতে মুখরিত গৃহস্থাশ্রমই তো সর্বাধিক সরস ।
৩৯) ব্রাহ্মণের এইরূপ উৎসাহ আর আগ্রহ দেখে ওই সন্যাসী মহাত্মা বললেন , প্রারব্ধের উপর হঠকারিতা করতে গিয়ে রাজা চিত্রকেতুর অশেষ কষ্টভোগ হয়েছিল ।
৪০) সুতরাং দৈব যেমন মনুষ্যের সকল প্রচেষ্টা বিফল করে দেয় সেই মনুষ্যের মতন তোমার ভাগ্যেও পুত্রসুখ নেই । তুমি তো বিষম জিদ ধারণপূর্বক আমার কাছে প্রার্থীরূপে উপস্থিত হয়েছ ; এই অবস্থায় তোমাকে আর কিই বা বলব ?
৪১) সেই মহাত্মা সন্ন্যাসী যখন বুঝতে পারলেন যে এই ব্রাহ্মণ কোনো প্রকারেই নিজের হঠকারিতা ছাড়বে না , তখন তিনি ওই ব্রাহ্মণকে একটি ফল দিয়ে বললেন - " এই ফলটি তুমি তোমার ধর্মপত্নীকে খায়িয়ে দাও, এতে তার গর্ভে এক পুত্র উৎপন্ন হবে ।
৪২) এক বৎসর অবধি তোমার পত্নীকে প্রত্যহ সত্য , শৌচ , দয়া , দান , ভক্তি ও একাহারের নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে হবে । এইরকম কার্য সম্পাদন করলে তোমার স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন পুত্র অতি নির্মল এবং অত্যন্ত শুদ্ধস্বভাব সম্পন্ন হবে ।"
৪৩) এই কথপোকথনের পরে ওই যোগরাজ সন্ন্যাসী ওই স্থান পরিত্যাগ করলেন এবং আত্মদেবও আনন্দচিত্তে নিজ গৃহে ফিরে এলেন । গৃহে ফিরে ওই ব্রাহ্মণ ফলটি তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে অন্যত্র কোনো কাজে বেরিয়ে গেলেন ।
৪৪) ওই ব্রাহ্মণের স্ত্রী তো ছিলেনই কুটিল স্বভাবের এবং তিনি রোদন করতে করতে তার এক সখীকে বলতে লাগলেন - " সখী রে , আমার মনের ভিতর এক বিষম চিন্তা উৎপন্ন হচ্ছে , আমি এই ফল ভক্ষণ করব না ।
৪৫) এই ফল ভক্ষণের ফলে আমার গর্ভের সঞ্চার ঘটবে , আমি গর্ভবতী হলে আমার উদর বৃদ্ধি হবে , যার দরুন আমার ক্ষুধাশক্তি হ্রাস পাবে এবং আমাকে স্বল্পভোজী হয়ে থাকতে হবে । এতে আমি অতি দুর্বল হয়ে পড়ব । এমতাবস্থায় আমি গৃহের নিত্য নৈমিত্তিক কর্ম কিরূপে সম্পাদন করব ?
৪৬) আর যদি দৈবাৎক্রমে কোনো দিন গ্রামে দস্যু-ডাকাতের বিপদ এসে উপস্থিত হয় তখন গর্ভবতী নারীরা কি প্রকারেই বা পলায়ন করবে ? অথবা মহর্ষি শুকদেবের মতন গর্ভ যদি ভূমিষ্টই না হয় তবে তাকে কিভাবে বের করা যাবে ?
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
৪৮) গর্ভধারণের ফলে আমি যখন দুর্বল হয়ে পড়ব তখন আমার ননদেরা বাড়িতে এসে বাড়ির সব আসবাবপত্র নিয়ে চলে যাবে । আর এই সত্য শৌচাদি নিয়ম পালনও আমার পক্ষে দুরূহ বলে মনে হচ্ছে ।
৪৯) যে নারী সন্তানের জন্ম দেয় তাকে ওই সন্তানের লালন পালনের জন্যেও অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় । তাই আমার মত অনুযায়ী বিধবা বা বন্ধ্যা নারীরাই প্রকৃত সুখী । "
৫০) মনের মধ্যে এইপ্রকার নানারকম কুতর্ক , কুচিন্তা করে ধুন্ধুলী ওই ফলটি খেল না । তার স্বামী আত্মদেব যখন বাড়ি ফিরে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে ফলটি ভক্ষণ করেছে কিনা ; তখন ধুন্ধুলী প্রত্যুত্তরে বলল - " হ্যাঁ খেয়েছি ।"
৫১) একদিন ঘটনাচক্রে ধুন্ধুলির ভগিনী তার বাড়িতে বেড়াতে এল ; তখন ধুন্ধুলী তার ভগিনীকে ঘটিত সমস্তকিছু বর্ণনা করে বলল যে - " আমার মনের মধ্যে এক মহতী দুশ্চিন্তার উদয় হয়েছে ।
৫২) এই দুশ্চিন্তার ফলে আমি দিনে দিনে কেবলই দুর্বল হয়ে পড়ছি । এমতাবস্থায় কি করা যায় বলতো বোন ? " তখন তার ভগিনী বলল - " আমার গর্ভে এক সন্তান রয়েছে । এই সন্তানের জন্ম হলে একে আমি তোমাকে দিয়ে দেব ।
৫৩) ততদিন পর্যন্ত গর্ভবতী নারীর মতন গুপ্তভাবে সুখে বাস করতে থাকো । এর দরুন তুমি কিছু অর্থ আমার স্বামী কে প্রদান কোরো , সে তার ছেলেকে তোমাকে দান করবে ।
৫৪) আর এই ব্যাপার আমি এমন ভাবে প্রচার করব যাতে সকলেই ভাবে যে আমার সন্তান গর্ভের ছয় মাসের মধ্যেই মারা গিয়েছে এবং আমি প্রত্যহ তোমার বাড়ি এসে তোমার ছেলেকে লালন পালন করতে থাকব ।
৫৫) তুমি এখন পরীক্ষা করবার জন্য এই ফলটিকে তোমার গৃহের ধেনু / গাভীকে ভক্ষণ করিয়ে দাও । " স্ত্রীসুলভ স্বভাববশত ওই ব্রাহ্মণী তার ভগিনীর কথামতোই কাজ করল ।
৫৬) এরপর যথাসময় উপস্থিত হলে ধুন্ধুলির ভগিনী তার সন্তান প্রসব করল এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নবজাতকের পিতা তার ছেলেকে ওই ব্রাহ্মণপত্নী ধুন্ধুলীকে দিয়ে দিল ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
৫৮) পিতা আত্মদেব পুত্রের জাতকর্ম সংস্কার করে ব্রাহ্মণদের দান দিলেন এবং এই উপলক্ষে আত্মদেবের গৃহে গীতবাদ্য ও নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হতে থাকল ।
৫৯) ইতিমধ্যে ধুন্ধুলী তার স্বামীকে বলল, আমার স্তনে তো দুগ্ধই নেই নবজাতকের জন্য । তাহলে গোমাতা বা অন্য প্রাণীর দুধেই বা কি করে আমি এই বালককে লালন পালন করব ?
৬০) আমার ভগিনীও সম্প্রতি গর্ভবতী হয়েছিল যদিও তার সন্তান গর্ভেই মারা গিয়েছে কিন্তু তাকে ডেকে এনে যদি নিজের কাছে রাখি তাহলে সে তার স্তনদুগ্ধ দিয়ে এই শিশুর পোষণ করবে ।
৬১) এই কথা শুনে আত্মদেবও নিজ পুত্রের মুখ চেয়ে প্রস্তাবে রাজি হলেন । মাতা ধুন্ধুলী ছেলের নাম রাখলেন ধুন্ধুকারী ।
৬২) এইভাবে তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওই গৃহের গোমাতাও এক মনুষ্যশিশুর জন্ম দিলেন । সেই শিশুটি ছিল সর্বাঙ্গ সুন্দর , দিব্য , নির্মল ও কনক/হেম প্রভাময় ( সোনার মতন কান্তিমান ) ।
৬৩) নবজাতককে দেখে ওই ব্রাহ্মণ খুবই আনন্দিত হলেন এবং তিনি নিজেই ওই নবজাতকের সকল সংস্কার করলেন । এই সংবাদ পেয়ে সকলেই খুব আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং তারা সকলেই ওই নবজাতককে দেখতে এলেন ।
৬৪) তারা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতে লাগল যে - " দেখো আত্মদেবের কেমন সৌভাগ্যের উদয় হয়েছে । এ বড়োই আশ্চর্যের ব্যাপার যে ধেনুর গর্ভ থেকে এই দেবরূপী পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে ।"
৬৫) দৈবযোগের প্রভাবে কেউই এই গুপ্ত রহস্যের ব্যাপারে অবগত হলেন না । নবজাতকের কান গোমাতার মত হওয়ায় আত্মদেব তার নাম রাখলেন গোকর্ণ ।
৬৬) এইভাবে কিছুকাল ব্যাতীত হওয়ার পর ওই বালকদ্বয় তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হল এবং পরে যুবক হল । বালকদ্বয়ের মধ্যে গোকর্ণ হল মহাজ্ঞানী ও বড় পন্ডিত , কিন্তু ধুন্ধুকারী হল মহাখল ও দুষ্ট ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
৬৮) অপরের দ্রব্যাদি চুরি করা ও সকলের প্রতি দ্বেষভাব পোষণ করা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল । অন্য লোকেদের গৃহে সে লুকিয়ে লুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দিত এবং অন্য লোকেদের সন্তানকে খেলার ছলে কোলে তুলে নিয়ে সে তাদের কূপে নিক্ষেপ করত ।
৬৯) হিংসা তার কাছে এক মহা আনন্দের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সর্বদাই সে অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্বক ঘোরাঘুরি করতো এবং অকারণে দীনদুঃখী , অন্ধ ও অসহায় ব্যক্তিদের লাঞ্ছনা করত । চণ্ডালদের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল ; সে তাদের মতো জাল হাতে করে সারমেয় / কুকুরের পালের সাথে ঘুরে বেরিয়ে পশু পাখি শিকার করত ।
৭০) পতিতা / বেশ্যাদের কুসঙ্গে পড়ে সে তার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি উড়িয়ে দিল । তারাপর একদিন আপন পিতা মাতা কে মারধর করে গৃহের সমস্ত পাত্র , আসবাব নিয়ে চলে গেল ।
৭১) এই ভাবে যখন সমস্ত ধনসম্পত্তি এক এক করে নষ্ট হয়ে গেলো তখন কৃপণ আত্মদেব উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে করতে বলতে লাগলেন - " এর থেকে তো আমার স্ত্রীর বন্ধ্যা থাকাই শ্রেয় ছিল কারণ কুলাঙ্গার কুপুত্র তো কেবল দুঃখদায়ীই হয় ।"
৭২) এখন আমি কোথায় থাকব ? কোথায়ই বা যাব ? আমার এই সংকটকালে কেই বা আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে ? হায় ! আমার এমন বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে যে এর জন্য আমাকে হয়তো একদিন প্রাণত্যাগ পর্যন্ত করতে হবে ।
৭৩) সেই সময় সেখানে পরমজ্ঞানী গোকর্ণ এসে উপস্থিত হলেন । তিনি পিতাকে বৈরাগ্যের উপদেশ দিলেন এবং অনেক করে বোঝালেন ।
৭৪) তিনি বললেন , " হে পিতা ! এই সংসার পূর্ণমাত্রায় অসার । এ কেবলই দুঃখদায়িনী এবং মোহ উৎপন্নকারী । পুত্র কার ! এই ধন সম্পত্তিই বা কার ! স্নেহে আচ্ছন্ন মানুষ দিবারাত্র প্রদীপের মতন কেবল অহর্নিশ জ্বলতেই থাকে ।
৭৫) সুখ তো দেবরাজ ইন্দ্রেরও নেই আর চক্রবর্তী সম্রাটেরও নেই , সুখ যদি থাকতেই হয় তবে তা কেবল বৈরাগী , একান্তে বসবাসকারী মুনি ঋষিদের মধ্যে বিদ্যমান ।
৭৬) " এ আমার ছেলে " এই অজ্ঞান পরিত্যাগ করুন । অজ্ঞান থেকে মোহ উৎপন্ন হয় এবং মোহ নরকপ্রাপ্তির কারণ হয় । এই অবয়ব তো একদিন নষ্ট হবেই । তাই সব কিছু পরিত্যাগপূর্বক অরণ্যে গিয়ে বসবাস করুন ।
শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যম্-চতুৰ্থ অধ্যায় |
৭৮) আমি অতি মুর্খ । আজ পর্যন্ত কেবলই কর্মবশত স্নেহপাশে আবদ্ধ থেকে পঙ্গুর ন্যায় সংসারের এই অন্ধকুপেই পড়ে রয়েছি । তুমি বড়ই দয়ানিধি , এখান থেকে আমাকে উদ্ধার কর ।"
৭৯) গোকর্ণ বললেন - হে পিতা ! এই দেহ কেবল অস্থি , মাংস আর রুধির পিন্ড ; এই দেহের প্রতি অহং ভাব আপনি পরিত্যাগ করুন এবং স্ত্রী- পুত্রাদির উপর কখনও মমতার পাশে আবদ্ধ হবেন না । এই অসার সংসারকে সর্বদা ক্ষণভঙ্গুর রূপে দেখবেন । সংসারের কোনো কিছুকেই স্থায়ী মনে করে তাতে আসক্ত হবেন না । কেবলমাত্র বৈরাগ্য রসের রসিক হয়ে সর্বদা ভগবৎভক্তিতেই নিমজ্জিত থাকুন ।
৮০) ভগবত-ভজনই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য কর্ম । অন্যান্য যাবতীয় লৌকিক ধৰ্মকর্ম সযত্নে পরিত্যাগ করুন এবং নিরন্তর ভগবত-ভজন নিয়েই থাকুন । সর্বদা সজ্জন সাধুব্যাক্তিদের সেবা করুন । কোনো প্রকার লৌকিক ভোগ বিষয়-বাসনার পাশে বদ্ধ হবেন না এবং যত শীঘ্র সম্ভব অপরের দোষগুন্ বিচার করা পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র ভগবৎসেবা আর ভাগবতরসই পান করতে থাকুন ।
৮১) পুত্রের এই উপদেশে প্রভাবিত হয়ে আত্মদেব গৃহত্যাগী হলেন ও অরণ্যমধ্যে যাত্রা করলেন । যদিও সেই সময় তিনি ষাট বৎসর বয়স অতিক্রম করেছিলেন তবুও তার বুদ্ধির প্রখরতা পুরোপুরিই বিদ্যমান ছিল । অরণ্যে গিয়ে দিবারাত্র ভগবানের সেবা করে আর নিয়ত শ্রীমদ ভাগবতের দশম স্কন্ধ পাঠ করে তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করেন ।
। ইতি শ্রীপদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে শ্রীমদ্ভাগবতমাহাত্ম্যে বিপ্রমোক্ষো নাম চতুর্থোহধ্যায়ঃ।
আসুন আমরা সবাই একসাথে শ্রীমদ্ভাগবতম / শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপপুরাণের স্বাধ্যায় করে আমাদের জীবন পুন্য করি | আজকের মতো এইটুকুই,আমরা শেষ করব মহামন্ত্র দিয়ে |
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে |
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ||
যদি আপনার এই পোস্টটি পছন্দ হয়ে থাকে / ভালো লেগে থাকে নতুবা এখান থেকে কিছু নুতন জানতে পারেন তাহলে আমাদের সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন এবং আপন আত্মীয়পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করবেন | আমার লেখা কেমন লাগলো তা অবশ্যই নিচে কমেন্ট বক্স এর মাধ্যমে কমেন্ট করে জানাবেন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতার উপর আমাদের টিউটোরিয়াল / শিক্ষামূলক সিরিজ পড়ার জন্য এই লিংকটি ক্লিক করে শ্রীমদ ভগবত গীতার অমৃতজ্ঞান পান করে জীবন পবিত্র ও পুন্য করুন |
শ্রীমদ্ ভগবত গীতা : https://bhagavadgitatutorial.blogspot.com
আপনারা আমার প্রণাম নেবেন |
ইতি
দীন ভক্ত দাসানুদাস
<--পূর্ববর্তী লেখনী পরবর্তী লেখনী-->
No comments:
Post a Comment